নিরপেক্ষ পরিবেশে ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া নিয়ে বিরোধীদের আন্দোলনের মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, “জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির ব্যবহার” নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।
নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালনেও সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিতভাবে অপচেষ্টা প্রতিহত করার আহ্বান জানান।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে নির্ভয়ে এসে স্বাধীনভাবে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন সিইসি।
বুধবার তফসিল ঘোষণার জন্য জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, সবার অংশগ্রহণই নির্বাচনকে এসব অনিয়ম থেকে দূরে রাখতে পারে।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই।
“রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। তাতে জনমতেরও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে সংহত ও টেকসই হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উৎকর্ষসাধন হয়।”
আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে এজন্য সংলাপে বসে সমাধান খোঁজার তাগিদও দেন তিনি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল এমন এক সময় সিইসি ঘোষণা করলেন যখন ভোটে অনিয়ম নিয়ে নানান সমালোচনার মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপিসহ সমমনা জোট ও দলগুলো। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই তারা ভোটে অনিয়ম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে আসছে।
২০১৮ সালের সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ভোটের ফলে তাদের ভরাডুবি হয়। সে সময় ‘আগের রাতে’ ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে দলটি। সংসদের মেয়াদের শেষ দিকে এসে তাদের নির্বাচিত এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এবারও ২০১৪ সালের মতো একই দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে রাজনীতিতে ফিরে এসেছে সহিংসতা। সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অবস্থানে অনড়।
দলগুলোর এমন রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালনের আহ্বান জানান।
একই সঙ্গে তিনি নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাদেরও আইন ও বিধি মেনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভোটকেন্দ্রসমূহের পারিপার্শ্বিক শৃঙ্খলাসহ প্রার্থী, ভোটার, নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
“জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির ব্যবহার আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে কোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করতে হবে।”
ভোটারদের উদ্দেশ্যে সিইসি বলেন, “নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে আপনাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে সংসদ ও সরকার গঠনে নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন। ভোট আপনার, ভোট দিতে কারও হস্তক্ষেপ বা প্ররোচনায় প্রভাবিত হবেন না।”
বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতি বিষয়ে সচেতন জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন বিষয়েও জনগণ সমভাবে সচেতন হয়ে এর গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করে থাকবেন। প্রার্থীরা সে বিষয়ে প্রচারণার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে থাকবেন। কমিশনও সর্বসাধারণ ও বিশেষত ভোটারদেরকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করতে প্রচারণামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।”
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিগত ২০ মাসে সংসদের ১৬টি উপনির্বাচনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের সহস্রাধিক নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা জানান হাবিবুল আউয়াল।
কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাহসী, সৎ, দক্ষ ও অনুগত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ রার জন্য প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানান সিইসি।
নির্বাচনের পথে বর্তমান ইসির কাযক্রম তুলে ধরে ভাষণে হাবিবুল আউয়াল বলেন, জাতীয় নির্বাচন একটি বিশাল, কঠিন ও জটিল কর্মযজ্ঞ।
“দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে; ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃ নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল এবং আগ্রহী দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন প্রক্রিয়াও সমাপ্ত প্রায়।
প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও বিশুদ্ধতা চান সিইসি
ভোটারদের উদ্দেশ্যে হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সহজীকরণ ও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। আইন ও বিধি-বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সার্বিকভাবে স্বচ্ছ, সহজ, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল করার জন্যে যে কোনো স্থান থেকে অনলাইন পদ্ধতিতে নমিনেশন দাখিলের এবং ডিজিটাল অ্যাপস চালু করা হয়েছে।
স্বচ্ছতা বা দৃশ্যমানতা নির্বাচনের বিশুদ্ধতা ও নিরপেক্ষতার জন্যে দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা চান সিইসি।
“পক্ষান্তরে অসত্য, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সম্প্রচার করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করার যে কোনো অপপ্রয়াস প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।”
তফসিল
>> মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর
>> মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর
>> প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর
>> প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর
>> প্রচার ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা
>> ভোট হবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি।
>> দেশে মোট ভোটার প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ
>> ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার
>> ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬২ হাজার
>> ৬৪ জেলায় ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার (ঢাকা ও চট্টগ্রামে ২ জন করে)
>> ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার
আরও পড়ুন: