বাবার মামলা খারিজ, দুই শিশু থাকবে জাপানি মায়ের কাছে

আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় নাকানোর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন তার সাবেক স্বামী ইমরান শরীফ।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2023, 11:13 AM
Updated : 29 Jan 2023, 11:13 AM

দুই সন্তানের জিম্মা পেতে বাংলাদেশে আসা জাপানি নারী নাকানো এরিকোর বিরুদ্ধে শিশু দুটির বাবা বাংলাদেশি ইমরান শরীফ যে মামলা করেছিলেন, তা খারিজ করে দিয়েছে আদালত।

রোববার ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান মামলাটি খারিজ করে রায় দেন। 

রায়ে বলা হয়, মামলাটির বিচার করার এখতিয়ার এই আদালতের আছে- এমনটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বাদী। তাছাড়া বাদী-বিবাদী ও শিশু দুটির সর্বশেষ বসবাসের স্থান জাপান হওয়ায় পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৬ (১) অনুযায়ী মামলাটি চলতে পারে না।

এর ফলে দুই শিশু সন্তান মায়ের জিম্মাতেই থাকবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন৷

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মায়ের পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এদের অভ্যাসগত বাসস্থান (হেবিচুয়াল রেসিডেন্স) জাপান। তারা জীবনে প্রথমবার এদেশে এসেছে। এরা বেড়াতে আসে নাই, বাধ্য হয়ে এসেছে। এজন্য তাদের যে অভ্যাসগত বাসস্থান- যেখানে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বাসস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত হবে, সেটা মায়ের বাসস্থানেই সম্ভব।”

তবে রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন শিশু দুটির বাবার আইনজীবী নাসিমা আক্তার লাভলী।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বাদীর সঙ্গে বিবাহের সময় বিবাদী ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছিলেন। সুতরাং তাদের বিবাহ মুসলিম রীতিনীতি মেনেই হয়েছে। তাই আইন অনুযায়ী তাদের সন্তান মুসলিম হবে। কিন্তু জাপানে তার মায়ের তত্ত্বাবধানে এই সন্তানদের মুসলিম রীতি-নীতি মেনে লালন-পালন করার মতো পরিবেশ নাই।

“এছাড়াও আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণে যেসব দলিল উপস্থাপন করেছি এবং যেসব নজির দিয়েছি- তার কোনো পর্যালোচনা এই রায়ে উল্লেখ করা হয়নি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। তাই আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই রায় চূড়ান্ত নয়।”

আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, জাপানে থাকাকালীন ওই দুই শিশু পড়াশোনায় খুবই মেধাবী ছিল এবং তাদের ফলাফলও খুব ভালো ছিল। মামলার আবেদন অনুযায়ী, ইমরান শিশু দুটিকে দেশে আনার পর নবোদয় প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু জেরাকালে ইমরান বলেছেন যে, নবোদয় নয়, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দুই শিশুকে ভর্তি করিয়েছিলেন। অর্থাৎ মামলার আবেদনের সময় ওই শিশুরা কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন না।

এভাবে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসা পর্যন্ত জাপানে পড়াশোনা করা দুই মেধাবী শিক্ষার্থীর নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা প্রক্রিয়ার ছেদ ঘটিয়েছেন বাদী, যা শিশুদের কল্যাণের জন্য মোটেই সমীচীন নয় বলে মনে করছে আদালত।

Also Read: নাকানো-ইমরানের দুই মেয়ের অভিভাবকত্বের রায় ২৯ জানুয়ারি

Also Read: সেই জাপানি মায়ের বিরুদ্ধে শিশুদের বাবার মামলা

Also Read: জাপানি মায়ের কাছে থাকবে দুই মেয়ে, পারিবারিক আদালতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

Also Read: দুই শিশু তাদের জাপানি মায়ের কাছেই থাকবে

মামলার নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফ জাপানের অবস্থান কালে ২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন।

দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন নাকানো।

এরপর স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে নাকানো জানান। পরে ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মা চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন নাকানো।

ঢাকার আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, টোকিওতে মামলা চলা অবস্থায় ‘মোকদ্দমার বিষয়বস্তুকে সরিয়ে’ দেশে এসে ইমরান মামলা করেছেন, যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাতে ওই শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, মাকে না জানিয়ে কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই অভ্যাসগত বাসস্থান থেকে হঠাৎ অন্য একটি দেশে শিশুদের এনে ইমরান মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করেছেন।

আদালতের রায়ে সন্তোষ জানিয়েছেন জাপানি নাগরিক নাকানো। তার এক মেয়ে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, তারা মায়ের সঙ্গেই থাকতে চায়, তবে বাবা দেখা করতে গেলে তার সঙ্গে দেখা করতেও আপত্তি নেই।

Also Read: ‘থাকব মায়ের কাছে, বাবা চাইলেই দেখা করব’

মেয়েদের ফিরে পেতে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসেন নাকানো। তিনি হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলে বিচারক।

কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাই কোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন মা নাকানো। পরে আপিল বিভাগ ওই বছর ১৫ ডিসেম্বর এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন।

পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং পরে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেয়।

এরপর আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয়, দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে তার নিষ্পত্তি পারিবারিক আদালতে হবে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের কাছেই থাকবে।

২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই রায় দেওয়া হয়। এরপর আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে আসে।

Also Read: জাপানি মায়ের দুই শিশুর বাবার আচরণে আদালতের উষ্মা

Also Read: হাই কোর্টের রায়: নাকানো-ইমরানের দুই শিশু থাকবে বাবার জিম্মায়

Also Read: জাপানি মায়ের ‘অবমাননাকর‘ ভিডিও অপসারণের নির্দেশ

এসব ঘটনার মধ্যে ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে দুই সন্তান নিয়ে জাপানে যাওয়ার জন্য ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান এরিকো নাকানো। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় তাকে বিমানবন্দর থেকে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়।

এ ঘটনায় নাকানোর বিরুদ্ধে অপহরণ ও প্রতারণার অভিযোগ এনে গত ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেন ইমরান শরীফ। সেখানে নাকানোর বিরুদ্ধে দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ করা হয়। আদালত বাদীর জবানবন্দি শুনে পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলে।

এ মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন গত ২২ জানুয়ারি শেষ হয়। ওইদিন মায়ের পক্ষে আইনজীবী শিশির মনির এবং বাবার পক্ষে নাসিমা আক্তার যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। এরপর আদালত রায়ের জন্য ২৯ জানুয়ারি দিন ঠিক করে।