হাই কোর্টের রায়: নাকানো-ইমরানের দুই শিশু থাকবে বাবার জিম্মায়

সন্তানদের জিম্মা নিয়ে জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি ইমরান শরীফের আইনি লড়াইয়ে কার্যত জিতলেন বাবা, তবে মায়ের অধিকার নিশ্চিত করতে তাকে যোগাতে হবে খরচ।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2021, 11:00 AM
Updated : 12 Dec 2021, 01:41 PM

বাংলাদেশের হাই কোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছে,  বর্তমানে ঢাকায় থাকা দুই মেয়ে তাদের বাবা ইমরান শরীফের কাছেই থাকবে। তবে মা সন্তানদের সাথে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন।

যেহেতু মা জাপানি নাগরিক এবং সেখানে বসবাস ও চাকরি করেন, সে কারণে তিনি তার সুবিধামত সময়ে বাংলাদেশে এসে সন্তানদের সাথে প্রতিবার কমপক্ষে দশ দিন একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। এক্ষেত্রে বছরে তিনবার বাংলাদেশে আসা-যাওয়াসহ দশদিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ ইমরান শরীফকে বহন করতে হবে। অতিরিক্ত সময়ে যাওয়া-আসা বা বাংলাদেশে অবস্থানের খরচ মাকেই বহন করতে হবে।

বাবা ইমরান শরীফ মাসে অন্তত দুইবার ছুটির দিন শিশু সন্তানদের সাথে মাকে ভিডিও কলে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবেন।

আর জাপানে মায়ের হেফাজতে থাকা ছোট মেয়ের নিরাপদ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে ইমরান শরীফ যে রিট আবেদন করেছিলেন, তা সরাসরি খারিজ করেছে হাই কোর্ট।

সন্তানদের কাছে পাওয়ার আশা নিয়ে এ দেশে আসা নাকানো এরিকোর গত কয়েক মাস বাংলাদেশে অবস্থান ও যাতায়াত খরচ বাবদ তাকে সাত দিনের মধ্যে ১০ লাখ টাকা দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

বাবা ও মায়ের দুটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এ রায় দেয়।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ইনায়েতুর রহিম বলেন, বর্তমান রিটিটি চলমান থাকবে।  কোনো পক্ষ যদি আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করে তাহলে অন্য পক্ষ আদলতে আসতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট সমাজ সেবা কর্মকর্তা শিশুদের বিষয়ে দেখভাল অব্যাহত রাখবেন। প্রতি তিন মাস পরপর শিশুদের বিষয়ে হাই কোর্ট বিভাগে প্রতিবেদন দেবেন তিনি।

আদালতে শিশুদের মা নাকানো এরিকোর রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আর বাবা ইমরান শরীফের আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।

রায়ের পর ফাওজিয়া করিম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যে শিশু অধিকারের কথা বলি, এই রায়টা হচ্ছে শিশু অধিকারের বড় উদাহরণ। এই রায়ে বাচ্চাদের জয় হয়েছে।”

আর নাকানো এরিকোর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, “লিখিত রায় বের হলে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। মামলাটি যেহেতু চলমান রাখা হয়েছে, তাই উভয় পক্ষেরই আদালতে আসার সুযোগ রয়েছে।”

জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো, ফাইল ছবি

বিচারকের প্রত্যাশা

রায় ঘোষণার আগে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আজকে সকালবেলা কিছু পত্রিকায়, মিডিয়ায় দেখলাম যে, জাপানি বাচ্চাদের অভিভাবকত্ব নিয়ে রায় হবে। আসলে আমরা অভিভাবত্ব সম্পর্কে কোনো রায় দিচ্ছি না। আমার মনে হয় মিডিয়ার অনেকেরই বোঝার ভুল ছিল। এটা হেবিয়াস করপাস, আমাদের এখতিয়ার অত্যন্ত সীমিত। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। নইলে একটা ভুল বার্তা চলে যেতে পারে।”

এ মামলার শুনানিতে আদালতকে সহযোগিতার জন্য দুই পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারক বলেন, “যদিও এটা হেবিয়াস করপাস মামলা, এ ধরনের একটি কনটেস্টিং মামলা, এখানে দুই পক্ষই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন উপস্থাপন করেছেন। আমরা নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব সহায়ক হয়েছে।

“তবে যেটা খুবই হৃদয় বিদারক, আমরা আজকে রায় বা আদেশ যাই দিই না কেন, কোনো না কোনো পক্ষ ভিকটিম হবেন। তারচেয়ে বেশি ভিকটিম হবে এই দুই সন্তান। আমরা আশা করব, বাবা-মা দুজনই ভবিষ্যতে আরও গঠনমূলক এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। আমরা সে সুযোগ রেখেই আদেশ দিচ্ছি।”

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আরেকটি কথা বলতে হবে যে, আমরা আপনদের সিদ্ধান্ত, যুক্তি সবকিছুই আমাদের যতটুকু সম্ভব বিবেচনা করেছি। বিবেচনা করতে গিয়ে আমরা আমাদের দুই শিশু সন্তানের সাথে তিনবার কথা বলেছি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও কথা বলেছি।

“সার্বিক বিবেচনায় আমরা মনে করেছি, বাচ্চাদের বর্তমান পর্যায়ে তাদের কল্যণে যে ধরনের আদেশ দেওয়া সমীচীন, তা দেব।”

বাবা-মায়ের আইনি লড়াই

নাকানো এরিকো (৪৬) পেশায় চিকিৎসক; বাংলাদেশি নাগরিক শরীফ ইমরান  (৫৮) একজন প্রকৌশলী। তাদের পরিচয় হয় টোকিওর একটি হাসপাতালে, যা পরিণয়ে গড়ায় ২০০৮ সালের ১১ জুলাই।

আদালতের তথ্য অনুযায়ী, দুজনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। দুজনের কেউই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি।

টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন। তাদের বয়স যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ বছর। তিন মেয়ে টোকিওর একটি স্কুলে পড়ত।

নাকানো ও ইমরান ২০২০ সাল পর্যন্ত একসঙ্গেই ছিলেন। দাম্পত্য কলহের জেরে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো।

এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান টোকিওর ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার এক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন নাকচ করে।

পরে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে এরিকোর ভাষ্য।

আদালতে জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো। ফাইল ছবি

২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করলে এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। সন্তানদের জিম্মায় চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন তিনি।

টোকিওর আদালত গত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেয়। তবে ওই আদেশ না মেনে ইমরান শরীফ শুধু একবার মায়ের সঙ্গে বড় দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন বলে এরিকো হাই কোর্টে করা আবেদনে বলেছেন।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।

এদিকে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে বড় দুই মেয়ের জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেয়। দুই মেয়েকে ফিরে পেতে এরিকো বাংলাদেশে আসতে চাইলে বাধা হয় মহামারী। শেষ পর্যন্ত ১৮ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় পৌঁছান।

এই জাপানি মায়ের ভাষ্য, মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ইমরান গত ২৭ জুলাই তাকে চোখ বেঁধে ‘অজ্ঞাত স্থানে’ নিয়ে যায়। তাতে তার মনে আশঙ্কা জাগে, ইমরান মেয়েদের আর কখনও তার সঙ্গে ‘দেখা করতে দেবেন না’। এ কারণে তিনি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

তার আবেদন শুনে হাই কোর্ট গত ১৮ অগাস্ট এক আদেশে দুই শিশুকে আদালতে হাজির করতে বলে। শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ ও তার বোন আমিনা জেবিনকে (শিশুদের ফুপু) ওই নির্দেশ দেওয়া হয়।

ইমরান শরীফ যাতে দুই মেয়েকে নিয়ে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দেয় আদালত।

এর মধ্যে গত ২২ অগাস্ট দুই শিশুকে ইমরান শরীফের বারিধারার বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারপর থেকে তারা মহানগর পুলিশের সাপোর্ট সেন্টারে ছিল। সেখান থেকেই গত ৩১ অগাস্ট দুই শিশুকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ।

উন্নত পারিবারিক পরিবেশে শিশুদের রাখতে তাদের মা এরিকো ও বাবা ইমরানের আবেদনের পর সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে ওইদিন আদেশ দেয় আদালত। ইমরান শরীফের ঠিক করা গুলশানের একটি ফ্ল্যটে দুই শিশুকে নিয়ে আপাতত ১৫ দিন একসাথে থাকতে বলা হয় তাদের।

ঢাকা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালককে বিষয়টি দেখভাল করতে বলা হয়। আর ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বলা হয়, শিশু ও মা-বাবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

কিন্তু সাত দিনের মাথায় গত ৩০ আগস্ট সে অদেশ পরিমার্জন (মোডিফিকেশন) চেয়ে আদালতে আবেদন করে নাকানো এরিকোর আইনজীবী। ৩১ আগস্ট সে আবেদনের শুনানির পর হাই কোর্ট সন্তানদের সথে মা-বাবার থাকা এবং তাদের সময় কাটানোর বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে দেয়।

আদালত বলে দেয়, মা-বাবা চাইলে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যেতে পরবেন। কেনাকাটা করতে পারবেন, বাইরে খেতে পারবেন।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলাটি আদালতে উঠলে দুই পক্ষই সম্পূরক আবেদন করে। মা নাকানো এরিকোর আবেদনে একটি আরজি ছিল শিশুদের সাথে মা-বাবার থাকা বা সময় কাটানোর সময়, দিনক্ষণ আলাদা করে দেওয়া। তাতে আপত্তি তুলেছিলেন শিশুদের বাবার আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ। আদালত তাতে কর্ণপাত না করে অদেশ দেয়।

এদিকে ইমরান শরীফ  জাপানে থাকা তার ছোট মেয়ের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত হতে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন।

সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ২১ অক্টোবর নাকানো এরিকোর রিটের সাথে ইমরান শরীফের রিটটিও শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে। কিন্তু এ বিষয়ে উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে থাকলে আদালত লিখিত যুক্তি দাখিল করতে বলে। চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিষয়টি রায়ের পর্যায়ে আসে।