বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে সেসব কনটেন্ট সরানোর নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি কারা এসব ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ‘সাইবার পুলিশ সেন্টারকে’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নাকানো এরিকোর করা অবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।
এদিন আদেশে সন্তানদের সথে মা-বাবার থাকা এবং তাদের সময় কাটানোর বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে আদালত। আদেশে বলা হয়েছে, আগামী ৯, ১১, ১৩ ও ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে ওই বাসায় মেয়েদের সাথে মা থাকবেন, বাবা থাকবেন না। বাকি সময়টা বাবা-মা দুজনেই শিশুদের সাথে থাকতে পারবেন।
তাছাড়া মা-বাবা চাইলে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যেতে পরবেন। কেনাকাটা করতে পারবেন, বাইরে খেতে পারবেন।
নাকানো এরিকো একজন জাপানি নাগরিক, পেশায় চিকিৎসক। ইমরান শরীফ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক।
আদালতে মায়ের আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আর বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
উন্নত পারিবারিক পরিবেশে শিশুদের রাখতে তাদের মা এরিকো ও বাবা ইমরানের আবেদনের পর সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে গত ৩১ আগস্ট আদেশ দিয়েছিল আদালত।
সে আদেশে ইমরান শরীফের ঠিক করা গুলশানের একটি ফ্ল্যটে দুই শিশুকে নিয়ে আপাতত ১৫ দিন একসাথে থাকতে বলা হয়েছিল তাদের।
ঢাকা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালককে বলা হয়েছিল বিষয়টি দেখভাল করতে। আর ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বলা হয়েছিল শিশু ও মা-বাবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
কিন্তু সাত দিনের মাথায় গত সোমবার সে অদেশ পরিমার্জন (মোডিফিকেশন) চেয়ে আদালতে আবেদন করে নাকানো এরিকোর আইনজীবী।
সে আবেদনে দুই মেয়ের সাথে মা এরিকোকে রাতে থাকতে দেওয়া এবং মেয়েদের নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া হয়। পাশাপাশি মেয়েদের সথে বাবা ইমরান শরীফের সময় কাটানোর সময় ঠিক করে দেওয়ার আরজি ছিল।
এছাড়া যে ফ্ল্যাটে শিশুদের নিয়ে তাদের (নাকানো এরিকো ও ইমনার শরীফ) একসাথে থাকতে বলা হয়েছে, ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষায় সেই ফ্ল্যাটে ইমরান শরীফের বসানো সিসি ক্যামেরাও অপসারণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।
আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “ওই ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরে ইমরান শরীফের স্থাপন সিসি ক্যামেরা অপসারণ করতে বলেছেন আদালত। তারা সেটি অপসারণ করবেন বলে আদালতকে আশ্বস্ত করেছেন।”
ইমরান শরীফের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু প্রতিপক্ষের আইনজীবী বলেছিলেন পরিবারিক সংহিসতা হতে পারে। তাই আমরা কিচেন এবং লিভিং রুমে সিসি ক্যামেরা ইনস্টল করেছিলাম। বেডরুমে কোনো ক্যামেরা আমারা ইনস্টল করিনি। আদালত বলেছেন সেগুলো অপসারণ করতে। সেগুলো অপসারণ করা হবে।”
দুই শিশুর অভিভাবকত্ব চেয়ে জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো রিট আবেদন করলে দুই শিশুকে হাজির করতে গত ১৮ আগস্ট নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ ও তার বোন আমিনা জেবিনকে (শিশুদের ফুপু) ওই নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইমরান শরীফ যাতে দুই মেয়েকে নিয়ে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য তাদের দেশত্যগে নিষেধাজ্ঞাও দেয় আদালত।
এর মধ্যে গত ২২ অগাস্ট দুই শিশুকে ইমরান শরীফের বারিধারার বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারপর থেকে তারা মহানগর পুলিশের সাপোর্ট সেন্টারে ছিল।
সেখান থেকেই গত মঙ্গলবার দুই শিশুকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর দুই পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শুরু হয়।
শুনানিতে শিশির মনির বলেন, “বাচ্চাদের মা ঢাকার বাড়িধারায় একটি বাসা ভাড়া করেছেন। আমরা চাই ওই বাসায় বাচ্চারা মায়ের সাথে থাকুক। বাচ্চাদের বাবাও তার মত করে ওই বাসায় আসুক-থাকুক। কারণ, এই কদিনে বাচ্চাদের মধ্যে যে একটা ট্রমা তৈরি হয়েছে, তা কাটুক। তারপর আপনারা এবিষয়ে চূড়ান্ত কোনো আদেশ দেন।”
অন্যদিকে ইমরান শরীফের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম বলেন, “বাচ্চারা বাবার বাসায় থাকুন। মা বাচ্চাদের দেখতে আসুক, কোনো সমস্যা নেই। মা যে বাসাটার কথা বলছেন, সেই এরিয়ায় বাচ্চাদের থাকার বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে।”
তখন বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আমরা চাই বাচ্চা দুটি পারিবারিক পরিবেশে থাকুক। আপনারা একটু পজিটিভলি ভাবুন।”
এরপর ফাওজিয়া করিম বলেন, “আমরা তাহলে দু-পক্ষ একটু বসে সিদ্ধান্ত নিই। তারপর আপনাকে জানাই। আপনি তখন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।”
এরপর ওইদিন বিকালে আদালত সিদ্ধান্ত জানায়।
আদালতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই নাকানো এরিকো (৪৬) ও ইমরান শরীফ (৫৮) বিয়ে করেন। দুজনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। দুজনের কেউই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি।
এর মধ্যে দাম্পত্য কলহ-বিবাদের জেরে গত ১৮ জানুয়ারি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো।
টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন। তাদের বয়স যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ বছর। তিন মেয়ে টোকিওর একটি স্কুলে পড়ে।
গত ২১ জানুয়ারি ইমরান টোকিওর ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার এক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন নাকচ করে।
পরে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে এরিকোর ভাষ্য।
২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করলে এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মায় চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন এরিকো।
টোকিওর আদালত গত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেয়। তবে ওই আদেশ না মেনে ইমরান শরীফ শুধু একবার মায়ের সঙ্গে বড় দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন বলে এরিকো হাই কোর্টে করা আবেদনে বলেছেন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।
এদিকে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে বড় দুই মেয়ের জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেয়।
বাংলাদেশের হাই কোর্টে করা রিট আবেদনে এরিকো বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এতদিন বাংলাদেশে আসতে পারেননি তিনি। গত ১৮ জুলাই শ্রীলঙ্কা হয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন।
এরিকো বাংলাদেশে এসে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার পর ফল নেগেটিভ আসে, কিন্তু শরীফ ইমরান তা ‘অবিশ্বাস’ করেন এবং ২১ জুলাই প্রাভা হেলথকেয়ারে কোভিড টেস্ট করাতে বলেন।
প্রাভায় প্রথমে ফল পজিটিভ এসেছিল। পরে জাপান দূতাবাসের সুপারিশে আবার কোভিড পরীক্ষা করালে ফল নেগেটিভ আসে।
কিন্তু শরীফ ইমরান তা অবিশ্বাস করছিলেন বলে আরও দুই দফায় কোভিড পরীক্ষা করান এরিকো। তাতেও ফল নেগেটিভই আসে। তিনি বাংলাদেশে আসার আগেই ফাইজারের দুই ডোজ টিকা নেন।
এরিকো জানান, ইমরান মেয়েদের সঙ্গে দেখা করাতে গত ২৭ জুলাই তাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এতে তার মনে আশঙ্কা হয়, ইমরান মেয়েদের আর কখনও তার সঙ্গে ‘দেখা করতে দেবেন না’। এ কারণে তিনি রিট আবেদন করেন।