যুক্তরাজ্যের শামিমাকে সিরিয়ায় পাচারে কানাডার গোয়েন্দা: বিবিসি

শামিমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করছেন তার আইনজীবীরা, তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে এই কিশোরী মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2022, 05:55 PM
Updated : 31 August 2022, 05:55 PM

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামিমা বেগম যুক্তরাজ্য থেকে এক কানাডিয়ান গোয়েন্দার সহায়তায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীর হয়ে যুদ্ধ লড়তে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন।

বুধবার বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন দাবিই করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যমটি বলছে, তারা যেসব নথি দেখতে পেয়েছে, সেখানে মোহাম্মদ আল রশিদ নামের ওই কানাডিয়ান এজেন্ট দাবি করেছেন, তিনি শামিমা বেগমের পাসপোর্টের তথ্যসহ আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে পাচার করা অন্যান্য ব্রিটিশ নাগরিকের তথ্য কানাডা সরকারকে জানিয়েছিলেন।

শামিমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করছেন তার আইজীবীরা, তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে এই কিশোরী মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন।

‘নিরাপত্তা ইস্যু’কে কারণ দেখিয়ে বিবিসির কাছে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি কানাডা ও যুক্তরাজ্য সরকার।

২০১৫ সালে শামিমার বয়স ছিল ১৫ বছর, যখন তিনি লন্ডনের আরও দুই স্কুলছাত্রী খাদিজা সুলতানা (১৬) ও আমিরা আব্বাসির (১৫) সঙ্গে সিরিয়া যান আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য।

ইস্তাম্বুলের প্রধান বাস স্টেশনে এই কিশোরীরা আল রশিদের সঙ্গে দেখা করেন। রশিদ তাদেরকে আইএস নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ায় ঢুকতে সহায়তা করেছিল।

আইএসের বিরুদ্ধে গঠিত আন্তর্জাতিক জোটের অংশ হিসেবে কাজ করা একটি সংস্থার একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন যে আইএসের জন্য মানব পাচার করার সময় কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাকে তথ্য দিয়েছিলেন রশিদ।

Also Read: ‘বদলে যাওয়া’ শামিমা পুড়ছেন ‘অনুতাপে’

রশিদের উপর তৈরি করা একটি বৃত্তান্ত বিবিসির হাতে এসেছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের সংগ্রহ করা তথ্য রয়েছে। ওই নথিতে রশিদের কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ থেকে উদ্ধার করা তথ্যও রয়েছে, যা থেকে তার কাজের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণও পাওয়া যায়।

রশিদ জানিয়েছেন যে তিনি যাদের সিরিয়ায় যেতে সাহায্য করেছিলেন, তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতেন, কারণ তিনি সেসব তথ্য জর্ডানে কানাডার দূতাবাসকে দিতেন।

শামিমাকে সিরিয়ায় আইএসের কাছে পাচারের কয়েক দিনের মধ্যেই তুরস্কে গ্রেপ্তার হন রশিদ। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, স্কুলছাত্রী শামিমার পাসপোর্টের একটি ছবিও তিনি কানাডা দূতাবাসে সরবরাহ করেন।

লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ যখন শামিমার খোঁজ শুরু করে, ততদিনে তিনি সিরিয়ায় পৌঁছে গেছেন। ওই সময়ই কানাডা তার পাসপোর্টের তথ্য পায়।

রশিদকে নিয়ে তৈরি করা একটি নথিতে বিবিসি দেখেছে, শামিমাকে সিরিয়ায় পৌঁছানো হয় আইএসের একটি বড় মানবপাচার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, যা ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘোষিত রাজধানী রাকা থেকে নিয়ন্ত্রিত হত।

রশিদ ওই নেটওয়ার্কের তুরস্কের অংশের দায়িত্বে ছিলেন এবং শামিমা ও তার দুই সহপাঠীকে পাচারের আট মাস আগে থেকে ব্রিটিশ নারী, পুরুষ ও শিশুদের সিরিয়ায় পৌঁছে দেওয়ার এই কাজ করে আসছিলেন।

বিবিসিতে প্রচারের অপেক্ষায় থাকা ‘আই অ্যাম নট আ মনস্টার’ পডকাস্টে শামিমা বলেন, “তিনি (রশিদ) তুরস্ক থেকে সিরিয়া পর্যন্ত পুরো ট্রিপটি আয়োজন করেছেন... আমি মনে করি পাচারকারীদের সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে আইএসের নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ায় প্রবেশ করা সম্ভবপর হত না।

“তিনি অনেক মানুষকে সিরিয়া প্রবেশে সাহায্য করেছেন ... তিনি আমাদের যা বলেছেন, আমরা শুধু সেটাই অনুসরণ করে গেছি। কারণ তিনি সবই জানতেন, আমরা কিছুই জানতাম না।”

রশিদ যাদের সাহায্য করতেন, তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন, প্রায়ই ওই ব্যক্তিদের পরিচয় সংক্রান্ত নথির ছবি তুলে রাখতেন বা গোপনে স্মার্টফোনে তাদের ছবি ধারণ করতেন।

একটি ফোন-ভিডিও রেকর্ডিংয়ে দেখা গেছে, শামিমা ও তার বন্ধুরা একটি ট্যাক্সি থেকে নেমেছেন এবং সিরিয়ার সীমান্তের কাছে আরেকটি গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন।

Also Read: শামীমা বেগম যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন না: সুপ্রিম কোর্ট

আইএস সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করছিলেন রশিদ। সিরিয়ায় আইএসের পশ্চিমা দেশের যোদ্ধাদের ঘরবাড়ির অবস্থান শনাক্ত করেছিলেন তিনি। আইএস নিয়ন্ত্রিত অংশে ইন্টারনেট ক্যাফের অবস্থান ও সেগুলোর আইপি ঠিকানাও সংগ্রহ করেছিলেন। আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে তার আলাপাচারিতার স্ক্রিনশটও সংরক্ষণ করেছেন।

নথিতে পাওয়া একটি আলাপচারিতায় দেখা গেছে, রশিদ একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাকে ব্রিটিশ আইএস যোদ্ধা ও রিক্রুটার (নিয়োগকর্তা) রাফায়েল হস্টি হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। রাফায়েল রশিদকে বলছিলেন, “আপনাকে আমার প্রয়োজন, আনুষ্ঠানিকভাবে ... আমি চাই মানুষজনকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আপনি সাহায্য করুন।”

এর জবাবে রশিদ জিজ্ঞেস করছিলেন, “দয়া করে, আপনি কি আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?”

রাফায়েল বলছিলেন, “একই কাজই করবেন, যা আপনি এখন করছেন। তবে আপনি আমাদের জন্য কাজ করবেন সরঞ্জাম আনার বিষয়ে, ভাই-বোনদের আনার বিষয়ে।”

জবাবে রশিদ বলছিলেন, “ভাই, আমি প্রস্তুত আছি।”

শামিমাসহ তিন ব্রিটিশ স্কুলছাত্রীকে সিরিয়ায় প্রবেশে সাহায্য করার কয়েক দিনের মধ্যেই তুরস্কের সানলিউরফা শহরে গ্রেপ্তার করা হয় রশিদকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেওয়া এক বিবৃতিতে রশিদ বলেন, শামিমাসহ যাদেরকে তিনি আইএসের সিরিয়ায় যেতে সাহায্য করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন, কারণ ‘আমি এসব তথ্য জর্ডানে কানাডার দূতাবাসে সরবরাহ করছিলাম’।

রশিদ জানান, ২০১৩ সালে তিনি জর্ডানে কানাডার দূতাবাসে যান এবং কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন, “তারা আমাকে বলেছিলেন, তারা আমাকে কানাডার নাগরিকত্ব দিতে পারেন, যদি আমি আইএসের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করি।”

বিবিসি নিশ্চিত হয়েছে যে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে রশিদ একাধিকবার জর্ডানে গেছেন এবং ফেরত এসেছেন।

Also Read: আইএসফেরত ‘নিঃসঙ্গ’ শামিমা চান সহানুভূতি

শামিমার পরিবারের আইনজীবী তাসনিম আখুনজি বিবিসিকে জানান, শামিমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জের আবেদনের শুনানি হবে নভেম্বরে এবং তাদের পক্ষ থেকে ‘অন্যতম একটি যুক্তি’ উপস্থাপন করা হবে যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ এই বিষয়টি বিবেচনায় নেননি যে শামিমা মানবপাচারের শিকার।

তিনি বলেন, “মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের আমরা কীভাবে দেখি এবং তাদের কৃতকর্মের বিষয়ে তাদের উপর আমরা কতটা দায় আরোপ করি, সে বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।”

তাসনিম আখুনজি বলেন, এটা জানতে পারা খুবই বেদনাদায়ক যে কানাডার হয়ে গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত একজন ব্যক্তি এই মানবপাচার কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন।

“এমন একজন, যাকে আমাদের মিত্র হিসেবে পাওয়ার কথা, যিনি ব্রিটিশ নাগরিকদের যুদ্ধক্ষেত্রে না পাঠিয়ে বরং তাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে শিশুদের জীবনের চেয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহই এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।”

শামিমা এখন উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার একটি বন্দি শিবিরে রয়েছেন। আইএসের কথিত খেলাফতের পতনের পর ২০১৯ সালে তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়।

শামিমাদের পাচারে রশিদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা সিএসআইএসের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, কানাডার অভিবাসন সংস্থা সিএসআইএসের তদন্ত, কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থ, পদ্ধতি বা কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে বা কোনো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারবেন না।

যুক্তরাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্রও একই কথা বলেন বিবিসিকে। “গোয়েন্দা কার্যক্রম বা নিরাপত্তা বিষয়ে আমরা মন্তব্য করি না, এটাই আমাদের দীর্ঘদিনের নীতি।”