বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার: আস্থা কেন টলছে?

প্রাথমিক মনোনয়ন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারের নীতিমালার মধ্যেই।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2024, 07:37 PM
Updated : 30 Jan 2024, 07:37 PM

এক দশক আগে পাওয়া বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ফেরত পাঠিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে দেশের প্রথম সারির এ পুরস্কার নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে চলা বিতর্ক নতুন করে উসকে দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।

তার ভাষ্য, "সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া বাংলা একাডেমির পরিচালনা পদ্ধতিতে সচেতন মানুষ আস্থা হারিয়েছে।”

কেন তিনি বাংলা একাডেমিকে ‘অগণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক’ বলছেন? কারণ একাডেমির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নির্বাহী পরিষদের ১৯ পদের মধ্যে ৭টিতে নির্বাচিত সদস্যরা থাকার কথা থাকলেও সেই নির্বাচন হয় না গত ২৫ বছর ধরে। বাকিরা সবাই পদাধিকার বলে কিংবা সরকারের মনোনীত হিসেবে পরিষদে এসেছেন। 

তাতে ‘ইচ্ছামত‘ লোক নিয়ে একাডেমি পরিচালনা এবং পুরস্কারের অলিখিত ‘কোটা’ ঠিক করে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। পুরস্কারের প্রাথমিক মনোনয়ন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়ায় একাডেমির মহাপরিচালককে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে খোদ পুরস্কারের নীতিমালার মধ্যেই।

এ বছর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য ১১টি ক্যাটাগরিতে ১৬ জনের নাম ঘোষণা করে গত বুধবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নামের তালিকা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই নানা বিতর্ক চলছে।

২০২০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করা হত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। এরপর থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কাজ সারছে একাডেমি।

প্রশ্ন উঠেছে, সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই সংবাদ সম্মেলন না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পুরস্কার ঘোষণা শুরু করেছে বাংলা একাডেমি। এ বছর পুরস্কারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় রাত ১০টায়। এ বিষয়কেও বাঁকা চোখে দেখছেন অনেকে।

এবার ফোকলোর বিভাগে পুরস্কারপ্রাপ্ত তপন বাগচীর একটি বই নিয়ে ‘চৌর্যবৃত্তির’ অভিযোগ তুলে তার পুরস্কারটি বাতিলের দাবি উঠেছে। তবে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তপন বাগচী। বাংলা একাডেমিও বলছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত নয়।

১৯৬০ সালে প্রবর্তিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার যে নীতিমালা অনুসরণ করে দেওয়ার কথা, তার সর্বশেষ সংশোধনে নাটক ক্যাটাগরিতে ‘আর্ট ফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্র’ নামে নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। কারো কারো অভিযোগ, ‘বিশেষ কাউকে’ পুরস্কার দেওয়ার জন্য নীতিমালায় ওই সংশোধন করা হয়েছে।

একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা অবশ্য বলছেন, ‘যথাযথ নিয়ম মেনেই’ পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে, এক্ষেত্রে মহাপরিচালকের প্রভাব বিস্তারের কোনো ‘সুযোগ নেই’। 

নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন হয় না কেন

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। দশ বছর পর গত রোববার সেই পুরস্কার ডাকযোগে বাংলা একাডেমিকে ফেরত পাঠিয়েছেন তিনি।

এই লেখকের অভিযোগ, প্রায় ২৫ বছর ধরে একাডেমির নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না হওয়ায় ‘ইচ্ছামত’ লোক নিয়ে একাডেমি পরিচালনা করা হচ্ছে।

বাংলা একাডেমি আইনে বলা হয়েছে, একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়া; একাডেমির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনে নীতি নির্ধারণ; সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন এবং সরকার বা সাধারণ পরিষদের দেওয়া দায়িত্ব পালন হবে নির্বাহী পরিষদের কাজ।

নির্বাহী পরিষদ হওয়ার কথা ১৯ সদস্যের, সেখানে ফেলোদের মাধ্যমে তিনজন এবং সাধারণ সদস্যদের মাধ্যমে চারজন নির্বাচিত হওয়ার কথা।

দীর্ঘদিন সেই নির্বাচন না হওয়ায় পরিষদে এখন আছেন ১২ জন। মহাপরিচালকসহ তাদের দুজন একাডেমি থেকেই এসেছেন পদাধিকারবলে, দুজনকে এই নির্বাহী পরিষদই মনোনীত করেছে, বাকি সবাই সরকার বা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মনোনয়নে পরিষদে এসেছেন।

জাকির তালুকদার বলেন, “নির্বাচিত সদস্যের পক্ষে কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় জোরালো ভূমিকা রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু ২৫ বছর ধরে নির্বাচন না দিয়ে সেই সুযোগ বন্ধ করে রেখেছে বাংলা একাডেমি। পছন্দের লোকদের নিয়ে অ্যাডহক কমিটি তৈরি করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মহাপরিচালকসহ একাডেমির কর্মচারী-কর্মকর্তারাই সর্বেসর্বা।"

তার ভাষ্য, বাংলা একাডেমির সমস্যা এবং কার্যক্রম নিয়ে গত ১০ বছরে তিনজন মহাপরিচালকের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু সুরাহা হয়নি। 

“কখনো একা, কখনো আরও কয়েকজন লেখক-কবির উপস্থিতিতে আমি কথা বলেছি। তাদের দুইজন প্রয়াত। একজন বর্তমানের মহাপরিচালক। তারা কেউ সমস্যাগুলোকে অযৌক্তিক বলেননি। কিন্তু প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়নি।"

আড়াই দশক আগে নির্বাচিত সদস্য হিসেবে বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদে ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদার। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির সাম্মানিক ফেলো।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।ওই সময় আমি নির্বাহী পরিষদে ছিলাম, ওই বছরই সবশেষ নির্বাচন হয়।”

নির্বাচন নিয়ে জাকির তালুকদারের অভিযোগের সঙ্গে রামেন্দু মজুমদারও একমত। তিনি বলেন, “একাডেমি পরিচালনায় নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন ভীষণ জরুরি। এটা এত দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার কারণেই একাডেমিতে নানা রকম বিশঙ্খলা হচ্ছে।"

জাকির তালুকদারের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ওই লেখকের কোনো অভিযোগ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পাননি। ফলে তার অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে চান না।

নীতিমালার ফোকর

যে নীতিমালার মাধ্যমে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়, গত এক যুগে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দফায় দফায় নীতিমালা সংশোধন করে মহাপরিচালককে ‘সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ করে ফেলা হয়েছে।

একাডেমি ও পুরস্কার সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরস্কার প্রক্রিয়ায় মহাপরিচালকের ক্ষমতা বাড়ানো শুরু হয় এক যুগ আগে, প্রয়াত শামসুজ্জামান খান মহাপরিচালক থাকাকালে। পরে হাবিবুল্লাহ সিরাজী এবং মুহম্মদ নূরুল হুদা মহাপরিচালক হয়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।

কবিতা, কথাসাহিত্য, গবেষণা, নাটকসহ সাহিত্যের ১১ শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এর অর্থমূল্য তিন লাখ টাকা।

কোনো সাহিত্যিককে কেবল একবারই এই পুরস্কার দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে পারেন না।

বর্তমান নীতিমালায় বলা আছে, একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে একাডেমির ফেলোদের মধ্যে থেকে ৩০ জন প্রস্তাবক নির্বাচন করা হবে। প্রস্তাবকরা পুরস্কারের জন্য নাম প্রস্তাব করবেন এবং তা মহাপরিচালকের বরাবর পাঠাবেন।

বাংলা একাডেমি প্রতি বছর ২০ জানুয়ারির মধ্যে দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, একাডেমির মহাপরিচালক এবং একাডেমির দুজন নির্বাহী পরিষদ সদস্যের সমন্বয়ে ৭ সদস্যের ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কমিটি’ গঠন করবে। 

কমিটি ‘প্রাপ্ত তথ্যসমূহ বিবেচনা করে ঐকমত্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে’ পুরস্কার দেওয়ার জন্য তাদের সুপারিশ করা নামের তালিকা বাংলা একাডেমি নির্বাহী পরিষদের সভাপতির কাছে পাঠাবে।

এরপর নির্বাহী পরিষদের সভাপতি উপস্থিত সদস্যদের ‘ঐকমত্য/সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে’ পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করবেন। নির্বাহী পরিষদ নতুন কাউকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করতে পারবে না।

নীতিমালা অনুযায়ী, পুরস্কার কমিটির সভাপতি হন একাডেমির মহাপরিচালক। নির্বাহী পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে থাকা একাডেমির মহাপরিচালকই পরে বিচারক দলের প্রধানের দায়িত্বে থাকেন।

ফলে পুরস্কারের প্রাথমিক মনোনয়ন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়ায় একাডেমির মহাপরিচালক এবং নির্বাহী পরিষদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ওই নীতিমালার মধ্যেই করে দেওয়া হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ।

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলছেন, তার সময়ে জুরি বোর্ডে একাডেমির মহাপরিচালকের যুক্ত থাকার বিধান ছিল না।

ভাষাবিদ, শিক্ষক ও গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ২০০৭ সালের মে থেকে ২০০৯ সালের মে পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রবন্ধ ও গবেষণায় ২০১৮ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যখন একাডেমির মহাপরিচালক ছিলাম, তখন জুরি বোর্ডের সদস্য আমি ছিলাম না। পুরস্কারের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তখন মহাপরিচালকের কোনো সম্পৃক্ততা থাকত না।”

সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, তার সময়ে ফেলোদের সকলেই নাম প্রস্তাব করতে পারতেন। নির্ধারিত ৩০ জন ফেলো প্রস্তাবক হবেন, এমন ব্যাপারও ছিল না।

পুরস্কার নীতিমালার চতুর্থ অধ্যায়ের ৭ ধারায় বলা আছে, ঐকমত্য/সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি চূড়ান্ত না হলে কমিটির প্রত্যেক সদস্যের একটি করে ভোট থাকবে এবং ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভাপতির দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক একটি ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।

নীতিমালার চতুর্থ অধ্যায়ের ১০ ধারায় বলা আছে, পুরস্কার কমিটির সুপারিশকৃত কোনো নাম যৌক্তিক কারণে বিবেচনা না করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে একাডেমির নির্বাহী পরিষদ।

এর মধ্য দিয়ে জুরি সদস্যদের মনোনীত নামও নির্বাহী পরিষদ বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর এই নির্বাহী পরিষদের প্রধান হলেন একাডেমির মহাপরিচালক। সবশেষে চূড়ান্তভাবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন মহাপরিচালক বা তার মনোনীত প্রতিনিধি। অর্থাৎ মহাপরিচালকই চূড়ান্ত নির্ণায়ক!

পদাধিকার বলে একাডেমির নির্বাহী পরিষদের প্রধান এবং পুরস্কারের জুরি বোর্ডের প্রধান মুহম্মদ নূরুল হুদা অবশ্য দাবি করেছেন, এককভাবে মহাপরিচালকের দিক থেকে পুরস্কারে প্রভাবিত করার ‘সুযোগ থাকে না’।

“ফেলোরা যে নাম প্রস্তাব করেন, সেটি নির্বাহী পরিষদের সভাপতি হিসেবে মহাপরিচালক স্বাক্ষর করে জুরি বোর্ডে পাঠান। সেটি থেকে জুরি বোর্ড সুপারিশ করেন এবং তার চূড়ান্ত অনুমোদন হয় নির্বাহী পরিষদে। পুরো প্রক্রিয়ায় মহাপরিচালক যুক্ত থাকেন ঠিকই, কিন্তু এককভাবে প্রভাব তৈরি করতে পারেন না।”

পুরস্কারের জুরি বোর্ডে মহাপরিচালকের ভূমিকা থাকা উচিত নয় বলেই মনে করেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জুরি বোর্ডের সদস্য হবেন শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের খ্যাতিমান মানুষেরা। সেখানে একাডেমির মহাপরিচালকের কাজ কি থাকতে পারে? তার তো থাকার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। জুরি বোর্ড যাদেরকে চূড়ান্ত করবে, সেটি একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনক্রমে মহাপরিচালক সেটি সবাইকে জানিয়ে দেবেন। এটাই তো হওয়া উচিত।”

বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একাডেমি যেহেতু পুরস্কারের প্রবর্তক, সেখানে একাডেমির কোনো কর্মকর্তা বা নির্বাহী পরিষদের কোনো সদস্যই জুরি বোর্ডে থাকার প্রয়োজন নেই। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য এবং একাডেমির নিয়মিত বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়দের বাইরের থেকে যোগ্য কাউকে দিয়ে জুরি বোর্ড গঠন করা উচিত এবং জুরি বোর্ড যাদের চূড়ান্ত করবেন তাদের নাম প্রকাশ করাটাই কেবল মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা উচিত।”

নাটক ক্যাটাগরিতে কেন চলচ্চিত্র?

সবশেষ গত অগাস্টে পুরস্কার নীতিমালা সংশোধন করে নাটক ক্যাটাগরির সঙ্গে যুক্ত করা হয় সাহিত্যনির্ভর আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্র। এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী আসাদুজ্জামান নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাহিত্য পুরস্কারে চলচ্চিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। চলচ্চিত্রের জন্য তো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার রয়েছেই। চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষণার জন্য পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে, সেটা তো গবেষণা ক্যাটাগরিতেই দেয়া যায়। আলাদা করে নান্দনিক চলচ্চিত্র বা আর্ট ফিল্ম কেন? এটা বোধগম্য নয়। আর নাটক ক্যাটাগরির সাথে পাশাপাশি থাকলে তো খুবই বেমানান।”

নাটক ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্রকে যুক্ত করার ব্যাপারটি সমর্থন করেন না সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদারও। তিনি বলেন, “এটা কিসের চিন্তা থেকে করা হয়েছে, বুঝতে পারছি না। সাহিত্য পুরস্কারে চলচ্চিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আর নাটকের সঙ্গে এটা যুক্ত করা তো একেবারেই সঠিক নয়।”

বাংলা একাডেমি ১৯৬০ সাল থেকে সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে। প্রথম বছর থেকেই কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-গবেষণা, শিশুসাহিত্যের পাশাপাশি নাটক ক্যাটাগরিতেও এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

প্রথম বছর এ পুরস্কার পান আসকার ইবনে শাইখ। পরের বছর নূরুল মোমেন (১৯৬১) এবং তার পরের বছর মুনীর চৌধুরী (১৯৬২) এই পুরস্কার পান। এরপর আনিস চৌধুরী, সাঈদ আহমদ, মমতাজউদদীন আহমদ, জিয়া হায়দার, আবদুলল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, মান্নান হীরা, মাসুম রেজা, মলয় ভৌমিক, রতন সিদ্দিকী, সাধনা আহমেদসহ অনেকে এই ক্যাটাগরিতে ‍পুরস্কার পেয়েছেন।

কোনো কোনো বছর আবার যোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি বলে এই ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। গত বছর নাটকে যাত্রাশিল্পী মিলনকান্তি দে এবং সাহিত্যিক ফরিদ আহমদ দুলাল পুরস্কার পান।

এ বছর থেকে নাটক ক্যাটাগরির সঙ্গে যাত্রা/পালা নাটক/সাহিত্যনির্ভর আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্র যুক্ত করা হয়েছে। পুরস্কার পেয়েছেন মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক।

নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া মলয় ভৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাট্যসাহিত্যে হয়ত প্রতি বছর যোগ্য কাউকে পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে ফাঁকা থাকবে। কিন্তু এভাবে চলচ্চিত্রকে এখানে আনার তো কোনো যৌক্তিকতা নেই।”

এটা ‘এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত’ মন্তব্য করে ২০১৫ সালে নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, “এটা কেন করার প্রয়োজন হলো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

২০১৯ সালে নাটকে পুরস্কার পেয়েছেন অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাটক ক্যাটাগরি সঙ্গে আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্র তো একেবারেই বেমানান। এটা তো কোনোভাবেই যৌক্তিক হয় না। বাংলা একাডেমিতে কখনো কথা বলার সুযোগ তৈরি হলে আমি এ বিষয় নিয়ে বলব।”

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা এই পরিবর্তনে কোনো সমস্যা দেখছেন না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “চলচ্চিত্রের প্রথম দিকই কিন্তু চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্য নিজেই কিন্তু একটা সাহিত্যকর্ম। আর সাধারণ যে চলচ্চিত্র আছে, সেখান থেকে আর্ট ফিল্মের আলাদা একটা মর্যাদা আছে বলে এবার আর্টফিল্মকেও যুক্ত করার একটা প্রস্তাব এসেছিল। বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদ সেটি অনুমোদন করেছে। আমি মনে করি, এটা যুক্তিসঙ্গত।”

ক্যাটাগরির সংখ্যা না বাড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যুক্তি দিয়ে নূরুল হুদা বলেন, “এমনিতেই ১১টা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। তাই সংখ্যার দিকে না বাড়িয়ে এটি করা হয়েছে। এবার কিন্তু আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনির সঙ্গে মুক্তগদ্যও যুক্ত করা হয়েছে।”

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বায়তুল্লাহ কাদেরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিষদের ওই সভায় নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব আসে। পরে আলোচনা করে পরিষদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই নীতিমালায় নাটক এবং আত্মজীবনী ক্যাটাগরিতে নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়। আর নীতিমালায় যা আছে, তা আগেই ছিল।”

পুরস্কার নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, "সব পুরস্কার নিয়েই তো সমালোচনা হয়। আসলে পুরস্কারে তো সবাইকে সন্তুষ্ট করা যাবে না।"

তবে এখন পুরস্কারের ক্ষেত্রে ‘লবিং তদবির’ বেড়ে গেছে মন্তব্য করে এই শিক্ষক বলেন, এটা দেশের সামগ্রিক বাস্তবতা। এবার আমি পুরস্কার প্রক্রিয়ায় প্রথম যুক্ত থেকেছি। একটা বিষয় আমার খারাপ লাগছে যে লেখকরা নিজের জন্য তদবির করছেন। এটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার। অনেক গুণিজনই তো বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি, তাতে কি তারা অযোগ্য?"

কেবল পুরস্কার নয়, বাংলা একাডেমির ওপর নানাভাবে ‘আমলাতান্ত্রিক চাপ’ বেড়েছে বলেও বায়তুল্লাহ কাদেরীর ভাষ্য।

তিনি বলেন, "এখন তো মন্ত্রণালয় থেকেও নানাভাবে চাপ দেয়া হয়। সবকিছুতে তারা হস্তক্ষেপ করতে চায়। এতে বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।"