রাষ্ট্রদূতদের মূল নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের মতোই থাকছে বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
Published : 16 May 2023, 07:41 PM
বাংলাদেশে ছয় দেশের কূটনীতিকের ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ প্রত্যাহার করার পর আলোচনার মধ্যে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
ঢাকায় বিদেশি মিশন ও রাষ্ট্রদূতদের মূল নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল থাকছে বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
সরকারের নতুন পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন পররাষ্ট্র সচিব।
সম্প্রতি সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরবসহ ছয়টি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় কয়েক বছর আগের নেওয়া বাড়তি ব্যবস্থা (পুলিশ এসকর্ট) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
এনিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মাসুদ বিন মোমেনের আলোচনায় এই প্রসঙ্গ আসে।
বাড়তি নিরাপত্তা সরানোয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “মনে হয় না, আমার মনে হয় না। আপনারা, আমরা সামনের দিনগুলিতে হয়ত জানতে পারব।
“দুদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, সেগুলো অনেক সাবস্ট্যান্টিভ এলিমেন্টের সাথে জড়িত থাকে। এটা (নিরাপত্তার নতুন পদক্ষেপ) প্রটোকল রিলেটেড একটা জিনিস।”
রাষ্ট্রদূতের ‘নিরাপত্তা উদ্বেগ’ সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ে’ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
ছয় রাষ্ট্রদূতের চলাচলে ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ আর দেবে না সরকার
কূটনীতিকদের সুরক্ষা স্বাগতিক দেশকেই নিশ্চিত করতে হবে: যুক্তরাষ্ট্র
এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে বলেছেন, ভিয়েনা কনভেশন অনুযায়ী যেকোনো স্বাগতিক দেশকে সব কূটনৈতিক মিশন ও কর্মীদের সুরক্ষা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
সে প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বলেন, “তাদের নাম্বার অব নিরাপত্তা পার্সোনেল, সেটা তো কমেনি। … গানম্যান বা অন্যান্য প্রেমিসেসগুলো তাদের এবং তাদের দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতদের বাসভবনে, সেগুলো ইনট্যাক্ট রয়েছে।
“সুতরাং ভিয়েনা কনভেনশনে যে রেসপন্সিবিলিটিগুলো দেওয়া হয়েছে, হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে আমরা অবশ্যই সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আমরা সেগুলো ম্যানেজ করব।”
বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের মূল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আরেকটা জিনিস বলতে পারি যে, আমাদের বেসিক যে সমস্ত অবলিগেশন আছে রাষ্ট্র হিসেবে এবং সেটা বিভিন্ন দূতাবাস বা রাষ্ট্রদূতরা আছেন, তাদের বেসিক যে নিরাপত্তা, সেটা কখনই আমরা কম্প্রোমাইজ করব না, এটুকু আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
“আরেকটা হচ্ছে, অলটারনেটিভ ব্যবস্থাও আমরা রেখেছি, ব্যাটালিয়ন আনসার আছে, তাদেরকে অনেকদিন ধরেই প্রস্তুত করা হচ্ছে।”
ছয় দেশের কূটনীতিকের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রতিটি দূতাবাসেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা বিধান অব্যাহত রেখেছেন এবং রাষ্ট্রদূতদের পুলিশ প্রদত্ত গানম্যান নিয়োজিত আছেন।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক বছর আগে গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই কূটনীতিকদের অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশ এসকর্ট দেওয়া হচ্ছিল। তবে এখন বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো হুমকি নেই বলে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
তবে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ব্যাটালিয়ন আনসারের একটি দল তৈরি রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো দূতাবাস চাইলে অর্থের বিনিময়ে সেই সেবা নিতে পারবে।
ব্যাটালিয়ন আনসার দিয়ে বাড়তি প্রটোকল দেওয়ার ব্যবস্থা দুই-একদিনের মধ্যে দূতাবাসগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, “আমরা আনসারের ডিজির সাথে বসব, তাদের কী কী ফ্যাসিলিটিজ আছে এবং কী কী ব্যাপার আছে- সেটা দূতাবাসগুলোকে জানিয়ে দিব।“
বাড়তি পাহারা সরিয়ে নেওয়ার আগে দূতাবাসগুলো জানান হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখানে নোটিফিকেশনের ব্যাপার ছিল না। যখন হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটল, তারপরে আমাদের রেকর্ডসে আমরা দেখেছি, সেখানে তাদের থেকেও কোনো রিকোয়েস্ট আমরা খুঁজে পাই নাই বা আমাদের কোনো নোটিফিকেশনও হয়নি।
“সে সময় জঙ্গিবাদের উত্থানের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটার বিবেচনায় বা নিরাপত্তা বিবেচনায় বিষয়টা তখন দেওয়া হয়েছিল তাদেরকে এটা। পরবর্তীতে দেখা গেছে যে, এটা (বাড়তি পুলিশ) মূলত ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের কাজটাই করত, সুতরাং তাদের আসল যে নিরাপত্তার বিষয়টা সেটা কিন্তু অপরিবর্তিতই আছে।”
পররাষ্ট্র সচিব জানান, মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও সৌদি আরবের মিশন প্রধানরা এই অতিরিক্ত পুলিশ পাহারা পেতেন। আরও ২-৩ জন সময়ে সময়ে এই সুবিধা নিতেন।
রাষ্ট্রদূতদের নিজ দেশের পতাকা প্রদর্শনের বিষয়ে সরকারের অবস্থানের বিষয়ে এক প্রশ্নে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি, এটা সত্য যে… উদাহরণস্বরূপ নিউ ইয়র্ক বা জেনিভাতে, আমি নিউ ইয়র্কে কাজ করেছি, সেখানে কখনও ফ্ল্যাগ উড়ানোর কোনো সিস্টেমই নাই।
“অন্যদিকে, অনেক দেশে আছে যেখানে রাষ্ট্রীয় যত মিটিং-টিটিংয়ে যাবেন, তখন আপনি ফ্ল্যাগ উড়িয়ে যেতে পারবেন। কিছুটা তো নিজের উপরও থাকে।”
নিজে ইতালি ও জাপানে রাষ্ট্রদূত থাকার সময়ে পতাকা উড়ানোর কথা জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “কিন্তু এখন যদি আমি বাজারে যাই, আমি যদি আমার কলিগের বাসায় ব্যক্তিগত ইয়েতে যাই, তখন তো আমি ফ্ল্যাগ উড়াব না।
“সুতরাং… রাষ্ট্রদূতদের এটা… আই থিংক দে হ্যাভ সেন্স কি করা উচিত, কী করা উচিৎ না।”
ভিয়েনা কনভেশনের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বিদেশি কূটনীতিকদের নিজ নিজ দেশের পতাকা ওড়ানোর বিষয়ে বলা হয়েছে, “মিশন এবং এর প্রধানের মিশনের প্রধানের বাসভবনসহ মিশন প্রাঙ্গণ এবং তার পরিবহনে প্রেরক রাষ্ট্রের পতাকা এবং প্রতীক ব্যবহার করার অধিকার থাকবে।”
৩ দূতাবাসের নিরাপত্তায় যত পুলিশ সদস্য
এদিকে, সোমবার রাতে একটি টেলিভিশন টক শোতে পুলিশের এসকর্ট সরিয়ে নেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে তিন দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনারে দায়িত্বে কতজন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন, সেই সংখ্যা তুলে ধরেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
পুলিশের কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি জানান, সৌদি দূতাবাসের জন্য ৫৩ জন পুলিশ সদস্য থেকে পাঁচজন, ব্রিটিশ হাই কমিশনের ৩৬ জন থেকে সাতজন এবং মার্কিন দূতাবাসের জন্য ১৬৬ জন থেকে ৮ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
শাহরিয়ার আলম বলেন, “সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থাপনা, অ্যাম্বাসি, ক্লাব, সৌদি রিলিফসহ এখন ৪৮ জন মোতায়েন আছেন। তাদেরকে এসকর্ট কারে, ট্রাফিকে সহায়তা করতেন, পাঁচজন থাকতেন। এই পাঁচজনকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
“ব্রিটিশ হাই কমিশনের দূতাবাস, রেসিডেন্স, ক্লাব, মিলে ২৪ জন, বিভিন্ন কাউন্সিল স্টাফদের জন্য তিনজন, দুজন গানম্যান- এই ২৯ জন অব্যাহতভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এসকর্ট হিসাবে ৭ জন ছিলেন এই সাতজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস, বাসভবন ও অন্যান্য স্ট্যাবলিশমেন্টে ১১৭ জন ও দেশটির অন্যান্য কূটনীতিকদের বাসভবনে ৩৯ জন পুলিশ মোতায়েন থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “দুজন গানম্যান আছেন, রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার জন্য। ১৫৮ জন এখনো ডিউটি করছেন। এসকর্ট হিসাবে যে ৮ জন ছিলেন, তাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।”
পুলিশি পাহারার বাড়তি সুবিধা অনানুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “হলি আর্টিজানে অ্যাটাকের পরে, আপনারা জানেন, কূটনৈতিকপাড়ায় বিশেষ কিছু রাষ্ট্রকে তাদের দূতাবাসে, তাদের বাসস্থানে, তাদের অভ্যন্তরীণ চলাচলের সময়ে সেটা (বাড়তি নিরাপত্তা) হয়ত তারা আমাদের কাছে চেয়েছিলেন, পুলিশের কাছে বিশেষ করে.. এটা আনঅফিসিয়ালি দেওয়া হয়েছিল।”
অনানুষ্ঠানিকভাবে এই সুবিধা দেওয়ার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর কোনো ‘বাধ্যবাধকতা’ নেই বলে উল্লেখ করেন শাহরিয়ার আলম।
এই সুবিধা কেমন ছিল, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “গুটিকয়েক রাষ্ট্রদূতের গাড়ি যেন ট্রাফিকে আটকে না থাকে, তারা যেন ট্রাফিকে প্রায়োরিটি পান, তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারেন, সেজন্য আমাদের কিছু মন্ত্রীর গাড়িতে যে রকম থাকে, তারা এই ট্রাফিকে সহায়তা করার জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা পেতেন।”
নতুন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে নতুন করে আসা কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের অনুরূপ সুবিধা চাওয়াকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম বলেন, “শুধু কয়েকজনকে এই সুবিধা দেওয়া সমীচীন হবে না।”
এটা কূটনীতিকদের প্রাপ্যতার মধ্যে পড়ে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের কোনো দূতাবাসেই সেই হোস্ট কান্ট্রির পুলিশ বাহিনীর মূল সদস্যরা পাহারা দেন না, আমাদের রাষ্ট্রদূতদের বাসভবনও পাহারা দেন না এবং অন্যান্য যে কূটনীতিকরা কাজ করেন ডেপুটি রাষ্ট্রদূত, হাই কমিশনার, মিনিস্টার, তাদের বাসাতে বা অন্য কোনো দপ্তরে সে দেশের পুলিশ সদস্যরা পাহারা দেন না।
“আমরা এক্সেপশনালি যে কাজটা করে গেছি এতদিন এবং এখনো করে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের, সেটাতে পরিবর্তন হবে কিনা, ভবিষ্যতই সেটা বলবে। কিন্তু পুলিশ এসকর্টটুকু প্রত্যাহার করেছি। আমরা যা যা দেই, তার কোনো কিছু প্রত্যাহার করা হয়নি।”