প্লাস্টিক ব্যবহারে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে সড়কের নির্মাণ খরচ কমবে। কিন্তু সংস্কারে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি থেকে যাচ্ছে।
Published : 10 Oct 2022, 01:02 AM
বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী সড়কঘাটা এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা; এমন উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেশে এটাই প্রথম।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্লাস্টিক ব্যবহারে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে সড়কের নির্মাণ খরচ ও সময় কম লাগবে।
প্লাস্টিকের বর্জ্য নিয়ে নাকাল অবস্থায় এমন উদ্যোগ আশা দেখালেও এতে আবার রাস্তার সংস্কার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেই সঙ্গে তারা বলছেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে আন্তর্জাতিক আইন নতুন করে হলে এই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে।
বৃহত্তর ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক প্রকল্পের অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে গত অগাস্টে গাজীপুরে ১০০ মিটার সড়কটি নির্মাণ করা হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫১০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কের এক-পঞ্চমাংশ নির্মাণের জন্য বিটুমিনের সঙ্গে ৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যকে বালি ও পাথরের সঙ্গে মিশিয়ে এক রকমের শুষ্ক মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর সেই মিশ্রণকে ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে বিটুমিনের সঙ্গে মেশানো হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) গাজীপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল বারেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৯১ শতাংশ বিটুমিনের সঙ্গে ৯ শতাংশ প্লাস্টিক মেশানো হয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে ১০০ কেজি বিটুমিন লাগত, সেখানে এখন ৯১ কেজি বিটুমিন এবং ৯ কেজি প্লাস্টিকের মিশ্রণ লাগছে। আর যেভাবে বিটুমিন-ইটের খোয়া ব্যবহার করে কার্পেটিং করা হত, সেই আদলেই এটা করে মিশ্রণটি সড়কের ঢালাইয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে।”
পরীক্ষামূলক এ প্রক্রিয়ার জন্য ১০০ মিটার অংশ পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক বছর পর্যন্ত সড়কটি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এই প্রকল্পের সঙ্গে শুরু থেকে যুক্ত এলজিইডির সড়ক বাস্তবায়ন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু মো. শাহরিয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের নিজস্ব পরীক্ষাগারে তারা সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে দেখেছেন, তাতে সবচেয়ে ভালো ফলাফল এসেছে ৯ শতাংশ বর্জ্য মেশানোয়।
কোন ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করেছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “৮ মাইক্রনের নিচে যে পলিথিন, যা সরাসরি ল্যান্ডফিলে চলে যায় এবং পরিবেশ দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী, রিসাইকেল করার উপযোগী না; সেটাকেই আমরা দুই ইঞ্চি বাই দেড় সাইজে শ্রেডিং করে নিয়ে রিইউজ করেছি।”
তিনি জানান, এলজিইডির পরবর্তী পাইলট প্রকল্প হবে কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলায়। সেখানে আরও বড় আকারে প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হবে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ১ কিলোমিটার করে সড়ক প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে নির্মাণে ইতোমধ্যে অধিদপ্তরে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে পরিবেশ দূষণ কমাতে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যকে সড়ক নির্মাণে ব্যবহার করার পরামর্শ এসেছিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক গবেষণায়। তবে এখন জানা গেল, সড়ক ও জনপথ বিভাগও সেই পথেই হাঁটছে।
প্রকৌশলী শাহরিয়ার জানান, বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে রাস্তা তৈরির জন্য তারা ২০১৯ থেকে কাজ করছেন। প্রায় কাছাকাছি সময়, অর্থাৎ গত চার বছর ধরে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)-ও প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ বাস্তবায়ণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আশা যেখানে
২০২১ সালে বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার তিন গুণ বেড়ে গেছে। ২০০৫ সালে যেখানে ৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হত, ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ৯ কেজি।
করোনাভাইরাস মহামারীর ওই সময় শুধু ঢাকা নগরীতেই দৈনিক ৬ হাজার ৪৬৪ টন ময়লা উৎাদিত হত, যার ১০ শতাংশই ছিল প্লাস্টিক বর্জ্য।
সেই বর্জ্যের মাত্র ৩৭ শতাংশকে রিসাইকেল করা হয়েছিল, বাকি ময়লার ৪৮ শতাংশ যেত ল্যান্ডফিলে, ১২ শতাংশ নদী ও খালে গিয়ে পড়ত এবং অবশিষ্ট প্লাস্টিক শহরের আনাচে কানাচে কিংবা ড্রেনে গিয়ে পড়ত।
অপচনশীল প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে সড়কে তার ব্যবহার দূষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তা ছাড়া এটা যে ব্যয় সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে, তা বললেন এলজিইডির প্রকৌশলী শাহরিয়ার।
তিনি বলেন, বিটুমিনের দামের তুলনায় পলিথিনের খরচ ১০ গুণ কম।
“বিটুমিন হল এখন ৭০-৮০ টাকা কেজি। সেখানে পলিথিনের দাম কত হবে? অলমোস্ট ফ্রি বলা যায়, ৭-৮ টাকা কেজি। আমি ৯ শতাংশ ব্যবহার করছি। দেখা যাচ্ছে যে পার কিউবিক মিটারে যদি আমার নরমালি ২০ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে আমার ১৮ হাজার টাকা খরচ পড়বে। পার কিউবিক মিটারে ২ হাজার টাকা যদি খরচ বাঁচে, তাহলে একটা ৫ কিলোমিটারের রাস্তা বানাতে ১৫-২০ লাখ টাকা সেভিংস।”
শাহরিয়ার দাবি করেন, প্লাস্টিক ব্যবহার করার ফলে গাজীপুরের রাস্তাটি অন্তত ৫ বছর টিকবে, যেখানে বাংলাদেশের যে কোনো সাধারণ রাস্তা গড়ে ২-৩ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
বেশিদিন টেকার কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “নরমালি আমাদের বিটুমিনের সফটেনিং পয়েন্ট, মানে নরম হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। মজার ব্যাপার হল, আপনি যদি ওয়েস্ট প্লাস্টিক ইউজ করেন, এই সফটেনিং পয়েন্টটা ৬০ ডিগ্রিতে উঠে যায়।”
প্লাস্টিক দিয়ে নির্মিত সড়কের আরও সুযোগ সুবিধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাপমাত্রা যদি ৩৫ ডিগ্রি থাকে, চাকার টেম্পারেচার কিন্তু এমনিতেই তখন ৪০ ডিগ্রি থেকে ৪৫ ডিগ্রি হয়ে যায়। এমনিতেই কিন্তু রাস্তার ক্ষতি হয়ে যাওয়ার কথা।
“কিন্তু এই ওয়েস্ট প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে রাস্তা তো রাটিং হবেই না, বরং রাস্তার উপর পলিথিনের একটা পাতলা লেয়ার থাকবে। ফলে বৃষ্টির পানি এটার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না। বিটুমিনটা পাথরের গা থেকে খুলে আসবে না। তখন রাস্তাটা টেকসই হবে।”
হতাশা যেখানে
সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা আশাবাদী হলেও এই ধরনের উদ্যোগ ইতোমধ্যে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানান বেসরকারি সংস্থা পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (ইএসডিও) মহাসচিব শাহরিয়ার হোসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু এখানে একটা অ্যাডিটিভ মিক্স করা হয়েছে এবং যেটা সিন্থেটিক অ্যাডেটিভ, এই সিন্থেটিকের কারণে সিমেন্ট, পাথর ও বালির যে বাইন্ডিং, সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
“দেখা যাচ্ছে, এই রাস্তার রিপেয়ার কস্ট বেড়ে যাচ্ছে। যখনই হেভি ট্রাফিক হচ্ছে, তখন কোথাও কোথাও ভেঙে যাচ্ছে, বসে যাচ্ছে। ফলে এটার ব্যবস্থাপনা খরচ অন্য রাস্তার চেয়ে বেশি হচ্ছে। দুই নম্বর হলো, এতে মাইক্রো ফাইবার ছড়িয়ে পড়ছে, আরও যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।”
“আজ থেকে অনেক বছর আগে, ১৯৯৫ সালে যেটা আমেরিকা ব্যান করে দিয়েছে যে এটা সম্ভব না, এত বছর পরে আপনারা যদি সেই জিনিস আবার করতে চান…” বলেন তিনি।
আরেকটি জটিলতার দিক দেখিয়ে শাহরিয়ার বলেন, “এখন প্লাস্টিক কনভেনশন হতে যাচ্ছে, প্লাস্টিক ট্রিটি হতে যাচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে, মাইক্রো প্লাস্টিক কোনোভাবেই যাতে রিলিজ না হয় এবং সেটার জন্য ২০২৪ সালের মধ্যে আইন হবে।
“এই নভেম্বরে ফার্স্ট নেগোসিয়েশন মিটিং শুরু হচ্ছে এবং ২০২৩ সালের মাঝে সব নেগোসিয়েশন শেষ করে, ২০২৪ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন পাশ হবে। তো, যখন কনভেনশন তৈরি হবে, ট্রিটি হবে, তখন তো অটোমেটিক্যালি এই জিনিসগুলো বাইন্ডিংসের মাঝে চলে আসবে যে এগুলো ব্যবহার করা যাবে না। আপনি তখন কী করবেন? এই রাস্তা খুঁড়ে বের করবেন তখন? সেটার কস্ট কে বিয়ার করবে?”
এলজিইডি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এখান থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সওজ কর্মকর্তারা মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হওয়ার শঙ্কা একবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে তারা বলছেন, বিষয়টা কী ঘটে তা বোঝার জন্যই পাইলটিং করা দরকার।
সওজ’র টেকনিক্যাল সার্ভিসেস উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “মাইক্রোপ্লাস্টিক হলে বৃষ্টির সময় নদীর মাঝে প্লাস্টিক যাবে। সেই প্লাস্টিক মাছে খাবে। মাছ আপনি খাবেন। কিন্তু বিষয়গুলা বোঝার জন্যই আমাদের ট্রায়াল দেওয়া দরকার যে এটা কীভাবে লিক আউট করে। লিক আউট করলে পানির মাঝে যায় কি না, এই টেস্টগুলাই তো করতে হবে। দ্যাট ইজ আ গ্রে এরিয়া।”
এলজিইডি গাজীপুরের সড়কটি নির্মাণ করেছে ‘প্লাস্টিক ম্যান’ খ্যাত ভারতের বিজ্ঞানী ড. রাজাগোপালান ভাসুদেবানের ২০০১ সালে আবিষ্কৃত ড্রাই মিক্সিং পদ্ধতি অনুসরণ করে।
এক্ষেত্রে বর্জ্য প্লাস্টিক সংগ্রহ এবং তা ব্যবহার উপযোগী করার কাজ করেছে গ্রিন বাড ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ তাসনিম মাহমুদ বলেন, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই পদ্ধতিতে যেসব রাস্তা বানানো হয়, তা গত ২০ বছর ধরে ভালোভাবে টিকে আছে এবং তাতে খানাখন্দ কম তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আবার প্লাস্টিকের পরিবর্তে টায়ার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, “সবচেয়ে ভালো হলো টায়ার। টায়ার কিন্তু নন বায়ো ডিগ্রেড্যাবল, অপরচুনিটি কস্টও নাই। পলিথিনকে কিন্তু শ্রেড করে কমপ্রেস করে চীনে পাঠানো হয়, এটার একটা বিরাট মার্কেট আছে। টায়ারের প্রসপেক্টটা আমি দেখি না, ২০০ বছরেও ক্ষয় হয় না। আর টায়ার দিনদিন বাড়তে থাকবে বাংলাদেশে। এটকে যদি বিটুমিনের সাথে গলিয়ে ব্যবহার করা হয়, একটা বিরাট এনভায়রনমেন্টাল প্রোবলেমকে সলভ করা যাবে।”
বুয়েটের একই বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানও বলেন, বিশ্বের অনেকে দেশেই গাড়ির টায়ারকে বিটুমিনের সাথে বিকল্প হিসেবে যুক্ত করা হচ্ছে।