এমআরটি পুলিশ মেট্রোরেলের নিরাপত্তা-সেবা নিশ্চিত করতে পারবে?

সবকিছু ঠিক থাকলে শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের মেট্রোরেল চালু হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরেই।

কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2022, 04:51 AM
Updated : 15 Oct 2022, 04:51 AM

ঢাকার মেট্রোরেলের সার্বিক নিরাপত্তায় আসছে পুলিশের বিশেষ ইউনিট ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটি পুলিশ; সরকারের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ বাহিনী গড়ে তোলা হলেও প্রযুক্তিগত বিষয়, জবাবদিহি ও টেকসই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা এসেছে এক বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে।

সবকিছু ঠিক থাকলে শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের মেট্রোরেল চালু হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরেই। ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের এই পথের নয়টি স্টেশনের নিরাপত্তায় ৩৫৭ সদস্যের এমআরটি পুলিশ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, মেট্রোরেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত অনেক বিষয় থাকায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে জবাবদিহি ও টেকসই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা কম থাকত।

তবে ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক শঙ্কার কিছু দেখছেন না।

তিনি বলেন, টিকেট বিক্রি বা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো তো কর্তৃপক্ষই দেখবে। নিরাপত্তার বিষয়টি পুলিশ দেখবে। প্রতিটি স্টেশনে একটি কন্ট্রোল রুম থাকবে। মেট্রোরেলের পক্ষ থেকে থাকবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও।

এমআরটি পুলিশ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে জানিয়ে ছিদ্দিক বলেন, “এই ইউনিটের সদরদপ্তর থাকবে পূর্বাচলে। পুলিশ নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো দেখবে; এখানে কোনো সমস্যা হবে না।”

অন্যদিকে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ডিএমটিসিএলের চাহিদা অনুযায়ীই এমআরটি পুলিশ গঠন করা হচ্ছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আর নতুন এই মেট্রোরেলের জন্য নতুন ইউনিট গঠন হবে। কিছু প্রসিডিউর রয়েছে। সেটা শেষ হওয়ার পর নিশ্চয়ই চালু হবে নতুন ইউনিট।”

মেট্রোরেলে প্রতিদিন যাতায়াত করবেন হাজারো যাত্রী। প্রতিটি স্টেশনে এটিএম বুথ, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ও দোকান থাকবে; যে কারণে প্রত্যেকটি স্টেশনে পুলিশ ফাঁড়ির প্রস্তাব করেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ।

Also Read: মেট্রোরেলের ভাড়া সর্বনিম্ন ২০ টাকা, প্রতি কিলো ৫ টাকা

Also Read: মেট্রো রেল যাবে কমলাপুর পর্যন্ত, ব্যয় ৮০০০ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব

এমআরটিএ’র প্রস্তাব

ঢাকা ও এর আশপাশে পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মিত হচ্ছে, যার আওতায় থাকছে ১২৮ কিলোমিটার যোগাযোগ ব্যবস্থা। ডিএমটিসিএলের এ যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ৫১টি উড়াল ও ৫৩টি পাতাল স্টেশনসহ মোট ১০৪টি স্টেশন তৈরি হবে।

এমআরটি পুলিশ ইউনিট গঠনে ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে পুলিশ সদর দপ্তর ৮০৯ জন সদস্যের জনবলের একটি কাঠামো গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল।

সেখানে একজন উপ-মহাপরিদর্শক, একজন অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক, তিনজন পুলিশ সুপার, চারজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, তিনজন সহকারী পুলিশ সুপার, ১৪ জন পরিদর্শক, ২১ জন উপ-পরিদর্শক, একজন সার্জেন্ট, ৭৪ জন সহকারী উপ-পরিদর্শক, ২৫ জন নায়েক, ৬৩৯ জন কনস্টেবল রাখা হয়েছে।

তবে এর মধ্যে ৩৫৭ সদস্যের যে ইউনিট গঠন করা হচ্ছে, তাদের দায়িত্ব থাকবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের মেট্রোরেলে।

এক নজরে

  • শুরুতে মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা; পরবর্তীতে আরও প্রায় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

  • মেট্রোরেলের প্রতিটি সেটে থাকবে চারটি যাত্রীবাহী কোচ, দুই দিকে দুটো ইঞ্জিন।

  • প্রতিটি কোচ সাড়ে ৯ ফুট চওড়া। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন।

  • প্রতি কোচে ৪৮ জন করে বসতে পারবেন। মাঝখানের চারটি কোচ মোটরকার। এতে বসার ব্যবস্থা আছে ৫৪ জনের।

  • প্রতি স্কয়ার মিটারে আটজনের হিসাবে প্রায় ১৭০০ যাত্রী চলাচল করতে পারবে।

  • উত্তরা থেকে মিরপুর-ফার্মগেইট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচলে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের কম।

  • কোচগুলোর ভেতরে লম্বালম্বি দুই পাশে বসার আসন। প্রতিটি কোচে দুটি হুইল চেয়ার রয়েছে।

  • শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি কোচের দুপাশে সুপরিসর চারটি দরজা। তবে স্টেশনে এলে একপাশেই খুলবে।

  • ট্রেন থাকবে প্ল্যাটফর্মের সমতলে, ফলে সাধারণ ট্রেনের মত সিঁড়ির প্রয়োজন হবে না।

  • কোন স্টেশনে ট্রেন থামল, তা জানানো হবে ডিসপ্লেতে।

  • মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ৫ টাকা, সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ২০ টাকা।

উদ্বেগ কেন

বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হকের মতে, সরকারি সংস্থার অধীনে সেবার কাজটি যথাযথভাবে হয় না। আর বিশ্বের অন্য স্থানেও এই দায়িত্বটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।  

তিনি বলেন, “উন্নত বিশ্বে সরকার (মেট্রোরেল) বানায়, কিন্তু অপারেট করে প্রাইভেট সেক্টর। সরকারি সংস্থায় সুযোগ সন্ধানীরা থাকে। সেকারণে পুরো পৃথিবী পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে গিয়েছে।”

শামসুল হক বলেন, “পৃথিবীর প্রায় ১৭০ দেশে মেট্রোরেলে ব্যবস্থা চালু আছে। আশেপাশের দেশেও মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু কেউ এই দায়িত্ব নিতে চায় না। কারণ সরকার কোনোদিন সার্ভিস দিতে পারে না।

“কারণ সরকারের লোক কাজ করে না। কাজ না করলে ‘হায়ার ফায়ার’ করতে পারে না। জবাবদিহি করা যায় না, চাকরিটা পারমানেন্ট হয়ে যায়।”

বেসরকারি খাত ‘সবসময় যোগ্য লোককে রাখে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রাইভেট সেক্টরে লোক যোগ্যতা দিয়ে টিকে থাকে, আর সরকারি লোক গায়ের জোরে থাকে। তখন আর জনগণ সেবা পায় না।”

থাইল্যান্ডের ‍উদাহরণ টেনে এই বুয়েট অধ্যাপক বলেন, “সেখানে ২০০৪ সালে মেট্রোরেল চালু হয়, থাইল্যান্ড সরকার দায়িত্ব দেয় নিউ জিল্যান্ডকে। তারা সুন্দরভাবে অপারেট করছে। সমন্বিতভাবে মেইনটেন্যান্স, অপারেশন ও নিরাপত্তা এক ব্যক্তির হাতে থাকে। করপোরেট বিনিয়োগ যারা নিয়ে আসে। তারা জ্ঞান, ধ্যান, পূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। তাই তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা টেকসই হয়ে যায়।”

চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারি খাতে দেওয়ার উদাহরণ টেনে শামসুল হক বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাভ আসছে, আর ইমেজ অনেক বেড়ে গেছে। সরকার কোনোদিন সেবা দিতে পারে না। দুবাই অনেক এগিয়ে গিয়েছে কীভাবে, সব বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়েছে।

“সরকারি প্রতিষ্ঠান আড়ম্বর করে আরম্ভ করবে, এরপর ফাঁকিবাজি শুরু করবে। রেলের মতো হবে, জুট মিলের মতো হবে, সুগার মিলের মতো একটি সংস্থা হবে।”

কাজ কতদূর

ডিএমটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিদ্দিক বলেন, “পুলিশের নতুন ইউনিট গঠন করার ফাইলটি এখনও সচিব কমিটিতে রয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর তো বেশি দূরে নয়। এখনও নতুন পুলিশ ইউনিট গঠন হয়নি।

“সদস্যদের এক মাস আগেও পাওয়া গেলেও হবে। অর্থাৎ ১৬ নভেম্বর পেলেই তাদেরকে প্রশিক্ষণ কাজ শেষ করতে পারব।”

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি এমএম মোস্তাক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমানে প্রস্তাবনাটি সচিব কমিটিতে রয়েছে। সচিব কমিটিতে যে প্রস্তাবটি রয়েছে যেখানে ৩৫৭ জনবলের রাখা হয়েছে।

“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেওয়ার পর জনপ্রশাসনের অনুমোদন হয়েছে। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনও হয়েছে। এখন সচিব কমিটিতে রয়েছে। সচিব কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাবে এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পরই ইউনিট চালু হবে।”

মেট্রোরেল বড় একটি প্রকল্প, আর এই ইউনিট গঠন হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশের বড় একটা অংশ নিরাপত্তায় কাজ করছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “আমরা প্রস্তুত আছি। কাজ শুরু করতে পারব। পরবর্তীতে জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে নেওয়া যাবে। আপাতত গঠন কাঠামো দাঁড়াবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করব।”

পদ্মাসেতুর মতো শঙ্কা মেট্রোরেলেও?

বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “পদ্মা সেতু চালুর মতো উচ্ছ্বাসে দলবল নিয়ে উপচে পড়া যে ভিড় হয়; তখন আর কিছুই সামাল দেওয়া যায় না। ফলে ঝুঁকির মাত্রাটা আরও বেশি থাকে।

“পদ্মা সেতুর দুই পাশে থানা ছিল। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটেছে। এই ভুল এখানে করা যাবে না। ধরে নিতে হবে, অনেকেই দলেবলে আসবে কিন্তু ক্যাপাসিটি থাকবে না। সেই হিসেবে নিরাপত্তা কিন্তু অন্য মাত্রায় দিতে হবে।”

তিনি বলেন, “অন্যান্য এলাকা থেকে মানুষ আসবে মেট্রোরেল ভ্রমণের স্বাদ নেওয়ার জন্য। তাই এখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্যমাত্রায় নিতে হবে। এখানে পদ্মা সেতুর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়।”

‘সার্ভিস প্লানে ঘাটতি’

শামসুল হক জানান, মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর বিভিন্ন স্টেশনের আশাপাশের প্রচুর রাইড শেয়ার জড়ো হবে। প্রচুর মানুষের সমাগম হবে। এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা পারবে না।

তিনি বলেন, “মেট্রো স্টেশনের সার্ভিস প্লান করা হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে ভুলে আমরা করে ফেলেছি, ফলে এই জায়গায় আরও বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা লাগবে।”

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মেট্রোরেলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “পৃথিবীর যেকোন মেট্রোরেল করার আগে জানতে চাওয়া হয় স্টেশনের আশেপাশে জায়গা আছে কিনা, পথচারীর জন্য ১০ থেকে ১২ ফুটের ফুটপাত আছে কিনা...এই প্রশ্নগুলো করা হয় এই কারণে যে, যাত্রী কারা? যারা যাত্রী তারাই তো পথচারী। সুতরাং এগুলো জানতে চাওয়া পূর্ব শর্ত।

“কিন্তু আমাদের মেট্রোরেল করার আগে কী এগুলো জানতে চাওয়া হয়েছে? পর্যাপ্ত জায়গা কি রাখা হয়েছে স্টেশনগুলোর নিচে?”