এ ঘটনা সতর্কবাণী হিসেবে কাজ করবে। জাতীয় গ্রিড অটোমেশনের কাজ চলছে, যত দ্রুত হবে ততই ঝুঁকি কমবে বলেন তিনি।
Published : 06 Oct 2022, 06:24 PM
জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ে দেশের বড় একটি অংশে সাত ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিভ্রাটকে ‘দৃশ্যত’ স্বাভাবিক কারিগরি ত্রুটি উল্লেখ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এর পেছনে অন্য কোনো বিষয় রয়েছে কি না সেটা তদন্ত করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের জাতীয় সঞ্চালন লাইনে গত মঙ্গলবারের বিপর্যয়ের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তারা জানতে পেরেছেন, পূর্বাঞ্চলের ঘাটতি মেটাতে পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। ওই সময় আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জের দুটি সার্কিট এবং ঘোড়াশালের একটি সার্কিট ‘ট্রিপ’ করার কারণেই সেদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শুরু হয়।
এরপর একে একে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হতে থাকলে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে প্রতিমন্ত্রী জানান।
গত মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে ওই ক্রুটির কারণে সাত ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ ছিল না রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক এলাকায়।
মাঝে একদিন বিরতি দিয়ে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী; কীভাবে দুর্ঘটনার সূত্রপাত্র সেটির একটি প্রাথমিক ব্যাখ্যাও দেন তিনি।
তবে সঞ্চালন লাইন ব্যর্থ হওয়ার এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে তা পুনঃস্থাপন শুরু করতে পারার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের বিশেষ একটি দক্ষতার দিক বলেও মনে করেন নসরুল হামিদ।
ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ওই সময় পূর্বাঞ্চলে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ঘাটতি ছিল এবং পশ্চিমাঞ্চালে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বাড়তি ছিল। এর ফলে পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হচ্ছিল। ঘটনার সময় আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি দুটি্সার্কিট এবং ঘোড়াশাল এআইএস থেকে ঘোড়াশাল জিআইএস এলাকায় ২৩০ কেভি একটি সার্কিট ট্রিপ করায় পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
“ফলে পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায়। আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সিজনিত কারণে গ্রিড আন স্ট্যাবল হয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে পূর্বাঞ্চালের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে বিভ্রাটের সৃষ্টি করে।”
গ্রিড বিপর্যয় হলেও সঞ্চালন লাইনের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি না হওয়ায় সেটিকে অনেকটা স্বস্তির দিক হিসেবেই দেখছেন প্রতিমন্ত্রী।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের এ ঘটনা ‘অস্বাভাবিক’ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এরকম টেকনিক্যাল ফল্ট হতেই পারে। বিশেষ করে সাব স্টেশনগুলোতে হতে পারে। আমাদের অনেক পুরোনো সাব স্টেশন রয়েছে যেগুলো এখনও চলমান। কিছু সাব স্টেশনের আধুনিকায়ন হয়েছে।
“গ্রিড বিপর্যয় হলেও গ্রিড সিস্টেম ও বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহে কোনো ফিজিক্যাল ড্যামেজ পরিলক্ষিত হয়নি। সেজন্য কমিটি গ্রিড সিস্টেমের প্রটেকশন ডেটা, ট্রিপিং রেকর্ড এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিচালনা ডেটাগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।“
মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় কী কারণে কোথায় বিদ্যুতের জাতীয় সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল, সেদিন যোগাযোগ করেও বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দিলে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিশাল এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল।
তার ২৩ দিন পর মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৪ মিনিটের সময় সঞ্চালন লাইন আবার অকার্যকর হয়ে পড়লে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ) বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্ন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে ২০১৪ ও ২০১৭ সালে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়েছিল। ওই সময় গঠিত কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে তার কতটা বস্তবায়ন হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “অনেক সময় ঘটনাগুলো ম্যান মেইড থাকে, অনেক সময় থাকে না। এই ঘটনাগুলো খুবই টেকনিক্যাল। যেই সমস্যা হয় সেগুলো আমরা সমাধান করার চেষ্টা করি। সর্বশেষটা কী হয়েছিল তার একটা ধারণা আমরা পেয়েছি।
“আরও কোনো ব্যাপার আছে কি না সেটা গভীর পর্যালোচনা শেষে জানা যাবে। তবে এই ঘটনা থেকে যেই বিষয়টা জানা গেছে তা হল- আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে, বিশেষ করে এক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পেরেছি। ঢাকায় দেরি করে দিয়েছি এই কারণে যে, এখানে লোড অনেক বেশি থাকে। সেকারণে এখানে দেরি করে দেওয়া হয়েছে।“
কোভিড মহামারীকালীন দুই বছরে এ সংক্রান্ত কাজ পিছিয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা আমাদের জন্য একটা সতর্কবাণী হিসেবে কাজ করবে। আমরা অটোমেশনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। যত দ্রুত যেতে পারব, ততই ঝুঁকি কমে আসবে।
“পিজিসিবির যেই পরিমাণ অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। বিতরণের কাজ আমরা এগিয়েছি, কিন্তু সঞ্চালনের কাজ কম হয়েছে। পিজিসিবিকে আরও আধুনিক হওয়ার প্রয়োজন আছে।“
তার দাবি, বিভিন্ন উন্নত বিশ্বে বিদ্যুৎ রিস্টোর বা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে কয়েকদিন লেগে গেছে। আমাদের কর্মকর্তারা এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। এখানে অবশ্যই টেকনিক্যাল ফল্ট আছে। তবে সেটা বের করতে সময় লাগবে।
উৎপাদন কম বা বেশি হওয়ার মধ্যে এর সম্পর্ক নেই মন্তব্য করে নসরুল হামিদ বলেন, “সেটা যদি থাকত তাহলে ফিজিক্যালি অনেক বড় অঘটন ঘটত। এখানে ওই রকম কিছু হয়নি। কেবলমাত্র লাইনগুলো ট্রিপ করে গেছে। একটার পর একটা ট্রিপ করে গেছে। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে পারব।“
সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, পূর্বাঞ্চলে চাহিদা মেটাতে পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিদ্যুৎ আনছিলাম। লাইন ট্রিপ করে পশ্চিমাঞ্চলের বাড়তি বিদ্যুৎ যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখনই পূর্বাঞ্চলে সঞ্চালন ট্রিপ করলো। এখানে ডিমান্ড বেশি হওয়া বা সাপ্লাই কম হওয়ার ব্যাপার নয়। ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের মধ্যে আমরা ভারসাম্য রেখেই চলছিলাম।“
যেভাবে সঞ্চালন পুনঃস্থাপন
সংযোগ পুনঃস্থাপনের বর্ণনা দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৪ অক্টোবর দুপুর ১টার দিকে ১১ হাজার ১৯৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১০ হাজার ১৯২ মেগাওয়াট ও ২টার দিকে ১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১০ হাজার ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু দুপুর ২টা ৪ মিনিটের সময় জাতীয় গ্রিডে একটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চল সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ বিভ্রাট শুরু হয়। এর ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা জোন একযোগে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে তিনি জানান।
তবে জাতীয় গ্রিডের পশ্চিমাঞ্চল তথা খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর জোনে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল।
ঘটনার পর পরই বিদ্যুৎ বিভাগ, বিপিডিবি, ডিপিডিসি, পিজিসিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এনএলডিসি কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত প্রকৌশলীদের নিয়ে সঞ্চালন লাইন ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঘটনার ৩২ মিনিটের মধ্যে দুপুর ২টা ৩৬ মিনিটে সিরাজগঞ্জ-আশুগঞ্জ ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং ২টা ৪৩ মিনিটে ঘোড়াশাল জিআইএস থেকে এআইএস ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন সচল করা হয়। এরই মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়।
পর্যায়ক্রমে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, ভুলতা, হরিপুর, মেঘনাঘাট ও আমিনবাজার গ্রিড উপকেন্দ্রগুলো সচল করা হয়। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে বঙ্গভবনে ও বিকাল ৫টা ২২ মিনিটের সময় গণভবনের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়।
পাশাপাশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চলতে থাকে।
এরপর ধারাবাহিকভাবে আশুগঞ্জ-কুমিল্লা ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিকাল ৩টা ৩২ মিনিটে কুমিল্লা জোন, বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে কুমিল্লা-হাটহাজারি ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন সচল করা হয়।
আশুগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিকাল ২টা ৫৮ মিনিটের দিকে ময়মনসিংহ জোন এবং আশুগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন সচলের মাধ্যমে সন্ধ্যা ৬টা ২৩ মিনিটে সিলেট জোনে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়।
এভাবে ক্রমান্বয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়। রাত ৯টার দিকে সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চলীয় সঞ্চালন লাইন স্বাভাবিক করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করে উৎপাদন বাড়ানো হয়। রাত ১২টার দিকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা সম্ভব হয় বলে এদিন সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এ ঘটনায় পিজিসিবির পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা বুধবার ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট গ্রিড উপকেন্দ্র পরিদর্শনের মাধ্যমে কাজ শুরু করেন।
এছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে ও বাইরের বিশেষজ্ঞ নিয়ে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে।
আরও খবর
ফের গ্রিড বিপর্যয় কেন? বিদ্যুৎ বিভাগও অন্ধকারে
গ্রিড বিপর্যয়: দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট
গ্রিড বিপর্যয়: বিদ্যুৎ বিভাগের দুঃখ প্রকাশ, তদন্ত কমিটি