গ্রিড বিপর্যয়: দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট

এই জটিলতার কারণ খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে পিজিসিবি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2022, 07:40 AM
Updated : 6 Sept 2022, 07:40 AM

জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেওয়ায় রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল মঙ্গলবার।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) মুখপাত্র এবিএম বদরুদ্দোজা সুমন বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৪ মিনিটে সঞ্চালন লাইন ‘ট্রিপ করলে’ জটিলতা তৈরি হয়।

“এর ফলে বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী জোন এবং বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে যায়। আমরা ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ফিরিয়ে এনেছি। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে।”

এই জটিলতার কারণ খতিয়ে দেখতে পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী (সিস্টেম অপারেশন) বি এম মিজানুল হাসানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

কমিটিতে দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান বদরুদ্দোজা সুমন।

তিনি জানান, মেরামত শুরু হওয়ার পর ৯টা ৪০ মিনিটে রাজশাহীতে, ১০টা ১০ মিনিটে খুলনায় এবং ১০টা ৩০ মিনিটে বরিশালে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।

বিদ্যুৎখাত সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রথমে ইশ্বরদী-ভেড়ামারা ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন ‘ট্রিপ’ করে। এর প্রভাবে ভেড়ামারায় বাংলাদেশ-ভারত ৪০০ কেভি হাই ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের (এইচভিডিসি) একটি সার্কিট ‘ট্রিপ’ করে।

তাতে দেশের ২৪ জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়। ৪০ মিনিট পর বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও কোথাও কোথাও সরবরাহ স্বাভাবিক করতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যায়।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু করতেও কিছুটা বিদ্যুৎ লাগে। আবার কোনো কারণে কোনো সঞ্চালন লাইনে লোড বেড়ে গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।

কোনো কারণে কোনো কেন্দ্র বা সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো সিস্টেমে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কিছু এলাকা বিদ্যুৎহীন রেখে অথবা অন্য কোনো গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এনে ‘লোড’ সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা করা না গেলে অর্থাৎ লোড সমন্বয় না হলে অন্য কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ বাড়ে।

এভাবে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর নতুন করে কোনো কেন্দ্র বন্ধ হলে সরবরাহে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং একইভাবে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রও বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

  • কালবৈশাখী ঝড়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালীপুরে একটি বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে পড়ে ২৩০ কিলোভোল্টের সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২০১৭ সালের ২ মে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ জনপদের অন্তত ৩২ জেলার মানুষকে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়।

  • তার আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সঞ্চালন কেন্দ্রে বিপর্যয় দেখা দিলে ভারতের সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভারতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া। একই সময় দেশের উৎপাদনে থাকা সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে গেলে, ধস নামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়।

খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং বৃহত্তর ফরিদপুরসহ ২১ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্রিড লাইন থেকে ‘ট্রিপ’ করায় তার পুরো এলাকাই বেশ কিছুক্ষণ বিদ্যুৎহীন ছিল সকালে।

ওজোপাডিকোর বিতরণ লাইনে সাড়ে ১০টাক দিকে বিদ্যুৎ এলেও ‘ফুল লোড’ পাচ্ছিল না বলে দুপুরে জানান তিনি।

বিকালে আজহারুল ইসলাম বলেন, “আড়াইটার দিকে পুরো ঠিক হয়ে যাওয়ায় আর সমস্যা নেই। এখন যদি কোথাও বিদ্যুৎ না থাকে, সেটা উৎপাদন ঘাটতির জন্য।”

পিজিসিবির বরিশাল অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান পলাশ বলেন, ‘লাইনে ট্রিপ করায়’ সকাল ৯টা ৩ মিনিটে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভোলার ২২৫ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং ৯৫ মেগাওয়াট এজিকো পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। তাতে বরিশালের ছয় জেলায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে।

রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা নর্দান পাওয়ার কোম্পানির (নেসকো) রাজশাহী, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রাহকরা ৪০ মিনিট বিদ্যুৎহীন ছিলেন।

নেসকোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, “৪০ মিনিট বন্ধ থাকার পর ১০টার দিকে পুনরায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু জয়। প্রথমে চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। পরে তা বাড়তে থাকে।

“রাজশাহী মহানগরীতে ৮০ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে দুপুর ২টার দিকে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। এ কারণে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।”