“প্রত্যাশা করি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অবস্থানকে সম্মান জানাবে এবং ‘জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার’- এই ডকট্রিন মেনে চলবে,” বলেন সংসদ সদস্য আরমা দত্ত।
Published : 20 Aug 2023, 11:27 PM
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মূল সূত্র যেমন ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা’, তেমনি উভয় প্রতিবেশীর জন্য খুবই ‘গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগের’ বিষয়ও এটি; যা ছিল ভারত সফরে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে বলে জানিয়েছেন সাংসদ আরমা দত্ত।
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আমন্ত্রণে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে, যে দলের সদস্য ছিলেন আরমা দত্ত।
সফরকালে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, শান্তি, সৌহার্দ্য। এবং এটা এমন একটা বিষয় যা আমাদের জন্য মূল উদ্বেগের।
“কেননা আমরা আরও বেশি স্থিতিশীলতা চাই, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরকে সামনে রেখে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং অন্যান্য দেশে। কারণ, অন্যান্য দেশের উপরও বাংলাদেশের নির্বাচনে কৌশলগত প্রভাব রয়েছে। সুতরাং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে খুব গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘ইনসাইড আউট’ আলোচনা অনুষ্ঠানে ওই সফরে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংসদ সদস্য আরমা দত্ত।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এ সর্বশেষ পর্বটি।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ৬ থেকে ৯ অগাস্ট ভারত সফর করে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, আরমা দত্ত ও অধ্যাপক মেরিনা জাহান।
বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার পাশাপাশি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, বাণিজ্যমন্ত্রী পিযুষ গয়ালসহ অনেকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তাদের। এসব বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা ও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সমাজকর্মী আরমা দত্ত।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বড় পরিসরে দেখার চেষ্টা আলোচনার বিষয়বস্তুতে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “বড় পরিসর হচ্ছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, যেটা ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আর সম্পর্কের মূল সূত্র। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
উভয় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সফরে আলোচনা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে আরমা দত্ত বলেন, “অবশ্যই। কারণ দুদেশেই ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে। যেসব বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবে আলোচনা হয়েছে, এটা তার অন্যতম।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহাসিকভাবে খুব শক্তিশালী বন্ধন রয়েছে। আমরা দুদেশের মধ্যে খুব চমৎকার সম্পর্কের মধ্যে রয়েছি, যেটাকে সোনালী অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
“ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনের বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।”
আলোচনায় টাকা-রুপি বাণিজ্য, তিস্তা
টাকা ও রুপিতে বিনিময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে আরমা দত্ত এটিকে খুবই আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কেননা ইতিহাসে প্রথমবার বাংলাদেশ ও ভারত এ নিয়ে একমত হয়েছে।
“শুধু ডলারের উপর নির্ভরশীল না থেকে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে কীভাবে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ করা যায়। কারণ ইউক্রেইন যুদ্ধে ডলারের সংকট বাড়ছে। সুতরাং কীভাবে এই ডলার নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, যাতে টাকা ও রুপির মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও সহজ, গ্রাহকের সহায়ক হয়।”
বাণিজ্য ঘাটতি কীভাবে কমানো যায় সেটা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আরমা দত্ত বলেন, যেহেতু টাকা ও রুপিতে বিনিময়ের জন্য দুপক্ষ একমত হয়েছে, সেহেতু পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। গম ও পেঁয়াজের সংকট হলে দেখবে বলেছে ভারত।
তিস্তা ও কুশিয়ারার পানিবন্টন নিয়েও সফরে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পানিবন্টনের বিষয়কে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
‘জামায়াত নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন’
জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে এক প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আরমা দত্ত বলেন, “এখানে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। কেননা, জামায়াত এমন একটি দল, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ধ্বংসজ্ঞ করেছে। তখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি পায়।”
তিনি বলেন, “জামায়াতের উন্নতি আমরা দেখি না, আমরা তাদের জঙ্গিবাদ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন, এটা এমন দৃষ্টিভঙ্গি যেটা সুখকর নয়। এটাই দেশের ভেতরের এবং বাইরে মানুষ সবাইকে চিন্তায় ফেলে।
“কারণ, তারা এমন দল যাদের গণতান্ত্রিক নীতি নেই এবং তারা অসাম্প্রদায়িক নয়। এটাই খুবই দুশ্চিন্তার।”
একাত্তরের ক্ষত ‘তরতাজা’ থাকার মধ্যেই জামায়াত সময়ে সময়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইসলাম শান্তির কথা বলে। কিন্তু জামায়াত ইসলামের কথা বললেও কাজ করছে উল্টো। সে কারণে এটা বেশ উদ্বেগের।”
‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অবস্থানে সম্মান জানাক’
আওয়ামী লীগ সরকারের অনুকূলে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না- এমন প্রশ্নে আরমা দত্ত বলেন, “আমি প্রত্যাশা করি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অবস্থানকে সম্মান জানাবে এবং আব্রাহাম লিংকনের ‘জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার’ ডকট্রিন আছে, সেটা মেনে চলবে।”
তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের ভালো বন্ধু, রাশিয়াও। যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। এটা হতে পারে, আমি তাদের মনে কী আছে জানি না। আমরা প্রত্যাশা করি, বাইডেন সরকারের যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি বুঝবে এবং মেনে চলবে।
“তাদের দেশের তারা যখন নির্বাচন করে তখনতো কেউ হস্তক্ষেপ করতে যায় না। তারাই সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ এটা তাদেরই এজেন্ডা।”
যুক্তরাষ্ট্রের এমন ‘হস্তক্ষেপকে’ বেশ ধন্দের ও দুশ্চিন্তার হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, “এটা হতে পারে হয়ত তাদের বেশি ক্ষমতা আছে বলে। এবং সবাই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা চায় এবং আমরাও অবশ্যই স্থিতিশীলতা চাই, আমরা উন্নয়ন চাই, নারীর ক্ষমতায়ন চাই। যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী বলে যাচ্ছে।
“আমরা প্রত্যাশা করি, তারা যেটা বলে বেড়াচ্ছে, সেটাতে বাংলাদেশ যা করেছে তাতে সম্মান জানাবে এবং তাদের এজেন্ডা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারার সুযোগ বাংলাদেশ সরকারকে দেবে।”
বিরোধ থাকলেও চীন-রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা চলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রয়েছে। তারা ব্যবসা করছে এবং রাশিয়ার সঙ্গেও ব্যবসায় রয়েছে। হয়ত এগুলো তাদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলবে। আমি এমনটাই ভাবি, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা তাদের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে।”
গৃহকর্মীদের অধিকার
বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মানবাধিকারকর্মী আরমা দত্ত। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠানেও তাদের অধিকার নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই সদস্য।
গৃহকর্মীরা জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চললেও সেই বিবেচনায় সম্মান, মর্যাদা ও মজুরি ঠিকমত পাস না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গৃহকর্মীদের ‘কথা বলার জায়গা নেই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ কারণে আমরা তাদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা করছি, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের কথা বলতে পারে এবং পেশাদারী কর্মশক্তি হিসেবে অবদান রাখতে পারে।
“পেশাদার কর্মী হিসেবে বিবেচিত না হওয়ার কারণে, তাদের দরকষাকষির কোনো সুযোগ না থাকায়, কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকায়, তাদেরকে শোষণ করা চলছেই। তাদের দিকে মনযোগ দেওয়া দরকার, কারণ তারাওতো জিডিপিতে অবদান রাখছে।”
তিনি বলেন, “মানবাধিকারকর্মী হিসেবে লজ্জিত হই, এতসব প্রচেষ্টার পরও মানুষকে বুঝাতে পারিনি, এরা দাস নয়, মানুষ। তবে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।”
গার্মেন্টস কারখানার কাজের সুযোগের কারণেও আগের পরিস্থিতি থেকে তারা কিছুটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সম্পত্তিতে সমান অধিকার
সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের বিষয়ে এক প্রশ্নে আরমা দত্ত বলেন, এটা এখনও খুব সংবেদনশীল জায়গা। ইসলামে সম্পত্তির বিধান রয়েছে, যেটার মাধ্যমে নারীরা কিছু সম্পত্তি পায়।
“কিন্তু হিন্দু ও বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে এখনও পায় না। আমরা যদি একীভূত ফ্যামিলি কোড তৈরি করতে পারি, তাহলে সবাই সমান অধিকার পাবে।”
পুরুষরা অতটা জেন্ডার সংবেদনশীল না হওয়ায় পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিকতার ব্যাপার। আর এই পুরুষতান্ত্রিকতা চিন্তার জায়গাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ছেলে-মেয়ে উভয়কে সমান চোখে দেখলেও সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীকে বঞ্চিত করার ব্যাপার থেকে যাচ্ছে।”
এমন মানসিকতার পরিবর্তনে দেখতে পাওয়ার কথা উল্লেখ করে আরমা দত্ত বলেন, অনেক নারী এখন সম্পত্তির অধিকার পাচ্ছে। এটাতে আরও সময় নেবে। এটা নারীদের জন্য উদ্বেগের বড় উদ্বেগের এবং অনেক পুরুষকেও তারা সঙ্গে পাচ্ছে।
“হেবা বা দানের মাধ্যমে অনেকে ছেলে-মেয়ে উভয়কে সম্পত্তির সমান ভাগ করে দিচ্ছে। সুতরাং পরিবর্তন কিছুটা আসছে। আমরা মনে করি এখনও অনেক কিছু করার আছে। আমাদের পুরুষ সঙ্গীদের মানসিকতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা রাখা দরকার।”