সন্ধ্যায় মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কোনো সান্তনাতেই থামছিল না স্বজনদের কান্না আর আহাজারি।
Published : 11 Apr 2024, 11:24 PM
সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মুক্তা বেগমকে বাড়িতে রেখে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন বিল্লাল হোসেন; যাত্রার ঝক্কি এড়াতে বেছে নিয়েছিলেন ঈদের দিনকে।
স্বস্তির যাত্রার আশায় ভিড় এড়াতে পারলেও মৃত্যুকে ঠেকাতে পারেননি মুক্তা আর বিল্লাল। সদরঘাট দিয়ে দক্ষিণের পথে তাদের সেই যাত্রা পরিণত হয়েছে শেষ যাত্রায়। অনাগত সন্তানের পাশাপাশি একমাত্র মেয়ে তিন বছর বয়সী মাইশা আক্তারও তাদের সঙ্গে মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছে।
সদরঘাটে একটি লঞ্চের ছিঁড়ে যাওয়া রশির প্রবল আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছেন তারা, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তাদের দেহ; তিনজনের লাশ একসঙ্গে বুঝে নিতে আসা স্বজনরা মেনে নিতে পারছেন না এমন মৃত্যু।
এ তিনজনের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে আরও দুইজনের, যারা ঈদের সময় বাড়তি আয়ের আশায় রয়ে গিয়েছিলেন ঢাকায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যেতে বেছে নিয়েছিলেন এ দিনকে। প্রিয়জনদের সঙ্গে তাদের ঈদ আনন্দ আর ভাগাভাগি করা হল না।
ঈদের দিন বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে হঠাৎ একটি লঞ্চের ধাক্কায় টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি লঞ্চের ছিঁড়ে যাওয়া রশির আঘাতে সদরঘাটের পন্টুনে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ যাত্রী প্রাণ হারান। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাদের।
দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস বলছে, এমভি তাসরিফ-৪ ও এমভি পূবালী-১ রশি দিয়ে সদরঘাটের ১১ নম্বর পন্টুনে বাঁধা ছিল। এ দুটি লঞ্চের মাঝখান দিয়ে ফারহান-৬ নামের আরেকটি লঞ্চ ঢুকানোর সময় এমভি তাসরিফ-৪ লঞ্চের রশি ছিঁড়ে যায়।
ওই রশির আঘাতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে। কেউ কেউ পাশে থাকা লঞ্চের সঙ্গে বাড়িও খায়।
ঘটনার কিছু সময় পর মিটফোর্ড হাসপাতালে লাশের সুরতহাল করতে এসেছিলেন নৌ পুলিশের এসআই কুমারেশ ঘোষ।
দুর্ঘটনার কয়েকটি ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এক লঞ্চকে আরেক লঞ্চ ধাক্কা দেয়। ওই ধাক্কায় লঞ্চের মোটা রশি ছিঁড়ে মানুষের গায়ে ধাক্কা লেগেছে। তাতেই ঘটেছে হতাহতের ঘটনা।”
মর্মান্তিক এক ঘটনায় একটি পরিবারের নাই হয়ে যাওয়ার খবর শুনে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ছুটে আসেন বিল্লালের ফুফাতো বোন হনুফা আক্তার। মামাতো ভাইয়ের পরিবারের সবার এভাবে চলে যাওয়ায় আফসোসের শেষ নেই তার।
হনুফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাজীপুরের গাছা থানা বড় বাড়ি এলাকা থেকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বাড়ির পথ ধরেছিলেন মুক্তা বেগমরা।
৩০ বছর বয়সী বিল্লাল একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে সংসার চালাতেন। গৃহিণী মুক্তা ছিলেন ২৬ বছর বয়সী।
ঈদের দিন বাড়ির পথে যাত্রার বিষয়ে জানতে চাইলে হনুফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিল্লালের স্ত্রী ৬-৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সন্তান প্রসবের আগে তাকে বাড়িতে রেখে আসার কথা ছিল।
“ওয়াইফের এ অবস্থায় ঝঞ্জাটের কারণে ঈদের দিন রওনা করছে। এখন তো সবাই একসাথে মরে গেল। ওরাও শেষ, দুই বাচ্চাও শেষ।”
যাদের জন্য একটি পরিবারের এমন করুণ মৃত্যু সেই দোষীদের বিচার দাবি করেন তিনি।
মিটফোর্ড হাসপাতালে আহজারি চলছে এ ঘটনায় নিহত আরেক পরিবারের স্বজ্নদেরও।
ঢাকায় মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং করে সংসার চালাতেন পটুয়াখালী সদরের রিপন হাওলাদার। দুই সন্তানকে নিয়ে বরগুনার বেতাগীতে বাপের বাড়িতে থাকতেন তার স্ত্রী।
ঈদের সময়ে বাড়তি আয়ের আশায় ঢাকায় ছিলেন রিপন; স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে ঈদের দিনে তিনি বাড়ির পথ ধরেছিলেন। পরিবারের সঙ্গে দেখা করার আনন্দ এক ঘটনাতেই রূপ নেয় বিষাদে।
সদরঘাটে দুর্ঘটনা: দুই লঞ্চের পাঁচজন আটক
সদরঘাটে দুর্ঘটনা: ২ লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল, তদন্তে কমিটি
সদরঘাটে রশির আঘাতে প্রাণ গেল ৫ জনের
রিপনের সঙ্গে বাড়ির পথ ধরেছিল তার জেঠাশের (স্ত্রীর বড় বোন) মেয়েও; যিনি বনানীর একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন। স্বজনরা বলছেন, চোখের সামনে খালুকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান ওই ভাগ্নি।
স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করা হল না তার; বিপরীতে ঢাকায় থাকা স্বজনরা মিটফোর্ড হাসপাতালে এলেন ক্ষত-বিক্ষত লাশ বুঝে নিতে।
ঢাকার নতুন বাজার এলাকায় থাকতেন ৩৮ বছর বয়সী রিপন। একই এলাকায় থাকেন শ্বশুরকুলের অনেক আত্মীয়ও।
হাসপাতালে রিপনের বেয়াই (ভায়রার ভাই) শহীদুল ইসলাম বলেন, “আজ সকালেও আমরা একসঙ্গে নাশতা করেছি। এরপর দুপুরের দিকে রেডি হয়ে সদরঘাটে আসছে। এরপর শুনি, ও লঞ্চের ধাক্কায় মারা গেছে।”
সন্ধ্যায় মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কোনো সান্তনাতেই কান্না আর আহাজারি থামানো যাচ্ছিল না রোকসানা বেগমের; তিনি সদরঘাটে দুর্ঘটনায় নিহত রবিউল ইসলাম মোহনের বড় বোন।
ভাইয়ের দেওয়া ঈদ সালামির কথা বলে বলে বিলাপ করছিলেন তিনি; বুধবার রাতে কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জে গিয়ে ভাগ্নে মোহাম্মদ সুফিয়ানকে সালামি দিয়ে এসেছিলেন মোহন। বৃহস্পতিবার সালামি দিয়ে এসেছেন বড় বোনকে।
গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদরের নিশ্চিন্তপুরে হলেও ঢাকার জিনজিরায় থাকে মোহেনের পরিবার। তার মুত্যৃর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন তার বাবা আব্দুল্লাহ, মা নুরুন্নাহারসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।
স্বজনরা জানান, ফেরি করে পানি, পিঠা প্রভৃতি বিক্রি করতেন মোহন। অন্য দিনের মতো বৃহস্পতিবার সদরঘাটে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। এ ঘটনার আসল কারণ খুঁজে বের করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও তাদের।
আব্দুল্লাহ-নুরুন্নাহার দম্পতির সন্তানদের মধ্যে সবার বড় রোকসানা; সবার মধ্যে তৃতীয় ছিলেন ১৯ বছর বয়সী মোহন।
হাসপাতালে বিলাপ করে করে রোকসানা বলছিলেন বলেন, “ভাই আমার ছেলেকে ঈদ সালামি দিছে চাঁন রাতে। ২০০ টাকা দিছে ওরে, ও কত যে খুশি হইছে সুফিয়ান।
“আমার ভাই প্রত্যেকবার সালামি দিত, আজকে সালামি দিয়ে গেছে গা। আজকের সালামি সবচেয়ে বেশি দিছে, আর সালামি আমার লাগবে না।”