“রাজনৈতিক দলগুলোর এমন মারমুখী আচরণ পাল্টানোর পাশাপাশি আলোচনার টেবিলে বসা দরকার,” বলেন এক বিশ্লেষক।
Published : 29 Oct 2023, 12:59 AM
নির্বাচনের আগে দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ ও আলোচনার মধ্যে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে একের পর এক সংঘর্ষ সামনের দিনে আরও সংঘাতকে উসকে দেবে; ঘটনার পরপরই নানা শ্রেণি পেশার মানুষ ও বিশ্লেষক নতুন শঙ্কা ও সংশয়ের কথা বলেছেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাস তিনেক আগে আর তফসিল ঘোষণার সপ্তাহ কয়েক বাকি থাকতে এমন সহিংসতা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে অন্তরায় বলে মনে করছেন তারা।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও সমমনাদের অনড় অবস্থানের মধ্যে নির্বাচনের আগে এটি হরতাল আর সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতিকে আরও উসকে দেবে কি না তা নিয়ে ভাবনার কথা জানালেন অনেকেই।
শনিবার দুপুরের আগে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশকে ঘিরে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এতে এক পর্যায়ে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়; রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয়, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা হয় আরও ডজনখানেক যানবাহন।
দৈনিক বাংলা মোড়ে একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়, আহত হন আরও অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য। সংঘর্ষের মধ্যে মৃত্যু হয় এক যুবদল নেতার।
এমন সহিংসতা ও হরতালের কর্মসূচির পর নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, “সামনে তফসিল, ভোটের আর কয়েক মাস বাকি। আলোচনা ও সমঝোতার কথাই বলছিলাম আমরা। কিন্তু অনড় অবস্থানে এমনটা এজাম্পশন করা হয়েছিল; সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
“শনিবার সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হল, সেটা যেই করুক না কেন তা খুবই অনাকাঙ্খিত, বেদনাদায়ক। গণতন্ত্রের জন্য ও নির্বাচনের জন্য এটা বিশাল অন্তরায়।”
এমন সংঘাতের পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
সংলাপ, সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই মন্তব্য করে আব্দুল আলীম বলেন, “মনে হচ্ছে-হয়ত বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে পাব কি না সন্দেহ। কিন্তু সমঝোতা যেন সুদূর পরাহত হওয়ার মতো বিষয় এখন। নির্বাচন মানে সমঝোতা। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কোথাও কোনো গ্যাপ থাকলে বা কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি না তার সমাধানের পথ বেছে নিতে হবে।
“সহিংসতা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। এখন যা হচ্ছে তাতে ভালো নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে সংশয় সৃষ্টি করছে।”
এমন শঙ্কার মধ্যেও সংলাপ-সমঝোতার আশা ছাড়ছেন না নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী।
নির্বাচনের প্রস্তুতিতে রাজনৈতিক এ সহিংসতা কোনো প্রভাব না ফেললেও আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার প্রয়োজনীয়তা আরও দৃশ্যমান হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে যথাসময়ে ভোটের। এ জন্য যা যা করণীয় সবই করা হয়ে যাবে। কমিশনের কাজে এটা কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর এমন মারমুখী আচরণ পাল্টানোর পাশাপাশি আলোচনার টেবিলে বসা দরকার।
“এখন কেমন নির্বাচন হবে এজন্য অপেক্ষা করতে হবে। তা নির্ভর করবে সামনে সময়ের উপর। আমরা আশাবাদী, দলগুলো একটা জায়গায় আসবে, শেষ সময়ে হলেও ইতিবাচক কিছু হবে।”
শনিবারের সহিংসতার ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক মন্তব্য করে জেসমিন টুলী বলেন, সুন্দর নির্বাচনের জন্য, সব দলের ভোটে আসার জন্য পরিবেশও অনুকূল করতে হবে। সামনে সময় রয়েছে।
“আশা করি, সমঝোতায় আসবে দলগুলো। এজন্য দলগুলোয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা, চাপও বেড়েছে।”
দেশে আবারও রাজনৈতিক সহিংসতা ফিরে আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মিরপুর রূপনগরের বাসিন্দা জাহিদ পাটোয়ারী বলেন, “দেশে আবারও রাজনৈতিক সহিংসতা ফিরে আসায় আমরা উদ্বিগ্ন।
“একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় আমাদের দেশের অর্থনীতিও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। মূল্যস্ফীতির চাপে আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তরা খুবই চাপের মধ্যে আছি। এখন আবারও হরতালের রাজনীতি ফিরে আসায় আমাদের চলাফেরা বন্ধ হয়ে যাবে।”
পেশায় শ্রমিক সরবরাহের সঙ্গে জড়িত এই ব্যক্তি বলেন, এখন যদি ঘর থেকে বের হতে না পারি তাহলে সম্পূর্ণভাবে আমার আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
“আবার হরতালের কারণে মাছ মাংস ও শাক-সবজির দামও বেড়ে যাবে।”
এমন রাজনীতিতে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই নোংরা রাজনীতি বন্ধ হোক। যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে তাদের দ্রুত বিচার হোক।”
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপ এর চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় তা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার যে অধিকার সংবিধানে দেওয়া আছে, সেই ইচ্ছা থাকলেও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা কার্যকর করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, সেটা আবারও প্রমাণিত হল।
“কারণ এ রকম আয়োজন যখন থাকে, সেখানে নানা ধরনের লোকজন থাকে। নাশকতা করার লোক থাকে। অনেকে পরিকল্পনাই করে রাখে যে, তারা নাশকতা করবে। যারা আয়োজনে থাকেন, তাদের এ বিষয়ে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না।”
তিনি বলেন, “নানা জায়গায় হামলা, এক পর্যায়ে বিজিবি নামানো হল। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিএনপি সভাস্থল থেকে চলে গেল। তারা আগামীকাল সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দিল। পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেয়া হল, পুলিশকে পিটিয়ে মারল। সবকিছু আসলে ২০০৬ সালের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখছি আমরা।”
সংবিধানসম্মত একটি পথেই শাসক দল থাকতে চাচ্ছেন বলে দাবি করেন।
কাকরাইলে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশে ব্যাঘাত ঘটাবে বলে মনে করছেন সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সহিংসতা যেটা হয়েছে, সেটা আমাদের কারোই কাম্য নয়। সহিংসতা হলে তা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশে ব্যাঘাত ঘটাবে। যাতে সহিংসতা না হয়, সেজন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরকার হবে।”
রাজনৈতিক দল ও সরকারের তরফ থেকে সহিংসতা ঠেকাতে কড়া বন্দোবস্ত নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।
কাকরাইলে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি’র সংঘর্ষে এবং দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ও পুলিশ বক্সে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন সাধারণ মানুষ।
ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফারহানা ইসলামের কণ্ঠেও তা ফুটে উঠল।
“আজকের ঘটনায় টেনশন বেড়ে গেছে। সামনে মেয়ের পরীক্ষা, প্রাইভেটে নিয়ে যেতে হয় ওকে। এখন তো বের হতেই ভয় লাগছে। কখন-কোথায় সহিংসতা শুরু হয় তা বোঝার উপায় নেই।”
এদিকে শনিবার ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সংঘাতের ঘটনার পর বিবৃতি দিয়েছে। এতে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ঢাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে এক্ষেত্রে ভিসা নীতি প্রয়োগের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এতে বলা হয়, “২৮শে অক্টোবর ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার নিন্দা জানায়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন রাজনৈতিক কর্মীহত্যা এবং একটি হাসপাতাল পোড়ানোর ঘটনা অগ্রহণযোগ্য।
“সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও তেমনই। আমরা সব পক্ষকে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানাই।”