পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য এনসিটিবির কার্যক্রমেও গলদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
Published : 11 Feb 2024, 12:35 AM
বিতর্ক এড়াতে বছরের শুরু থেকেই পাঠ্যবইয়ের কাঁটাছেড়া হচ্ছে, পাতায় পাতায় ভুল বেরিয়ে আসছে। ফেইসবুক থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত চলছে বিতর্ক; পাঠ্যবই নিয়ে কয়েক বছর ধরেই এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সরকারকে।
প্রতিবছর পাঠ্যবই সমালোচনার মুখে পড়ায় শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার কথা বলছেন অভিভাবকদের কেউ কেউ।
মানসম্মত বই লিখতে দক্ষ লোকের সংকট যে পাঠ্যবইয়ে ধরা পড়ছে, সেটি স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আর বিশেষজ্ঞরা পাঠ্যবইয়ের ভুলের জন্য এনসিটিবির কার্যক্রমেও গলদ দেখছেন।
গেল বছর সমালোচনার মুখে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। এই দুই শ্রেণির ৪০ বইয়ে ৪২৮টি সংশোধনী দিতে হয় এনসিটিবিকে। সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে ওয়েবসাইট থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন বইটি রচনা ও সম্পাদনায় যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।
চলতি বছর বই উৎসবের পরপরই সাতক্ষীরা ও ঠাকুরগাঁওয়ের কয়েকটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের মলাটের ভেতরে হিন্দু ধর্মের দেবী দুর্গার ছবি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। ‘মুদ্রণজনিত ভুলের’ কারণ দেখিয়ে পরে বইগুলো ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
এ বছর সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফার গল্প’। ঢাকায় প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষকের পাঠ্যবই ছেঁড়ার ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যে ওই গল্পে ভাষাগত পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে এনসিটিবি।
পাঠ্যবইয়ে প্রাচীন জেরিকো নগরীর ভুল মানচিত্র ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। ওই মানচিত্রে গাজার স্থানকে লেখা হয়েছে গাম্বিয়া। সে অঞ্চলের প্রাচীন স্থানগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের নাম দিয়ে। তাতে ইসরাইলের নাম এলেও ফিলিস্তিনের নাম না থাকায় সমালোচনা চলছে।
এছাড়া বানান ভুল, তথ্যগত ভুল ও তত্ত্বের ভুলের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে হুবহু লেখা তুলে দেওয়ায় পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মাধ্যমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের কিছু বিষয় শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী পাঠ উপযোগী কিনা, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
পাঠ্যবই রচয়িতরা কতটা দক্ষ?
মাধ্যমিকের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের লেখকদের একজন সিদ্দিক বেলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১০ থেকে ১২ জন লেখক একসঙ্গে একটি বই লিখতে বসেন। সেখানেই একেকজনের লেখার ভুল অন্যরা শুধরে দেন। এরপরও ভুল থাকলে সম্পাদনার সময় ঠিক করা হয়।
তাহলে কীভাবে পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকছে- সে বিষয়ে তার ভাষ্য, “আমরা লিখি। এরপরে প্রুফ দেখা, এডিট করার অনেক বিষয় থাকে।”
ঢাকার সহজপাঠ স্কুলের এই শিক্ষকের দাবি, যে ভুলগুলো সামনে আসছে, সেগুলোকে ‘বড় করে দেখার অর্থ নেই’। দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে ছোট ছোট বিষয়ে বেশি আলোচনা হলেও পাঠ্যবই নিয়ে আরও ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়ালে থেকে যাচ্ছে’।
“উপযুক্ত সম্পাদনা নেই, উপযুক্ত প্রুফ রিডার নেই- এটা আপনারা বলতে পারেন। কাগজের কোয়ালিটি, প্রিন্টিং কোয়ালিটি, বানানের ভুল….ইসরায়েলের অংশটা তো টাইপিং মিসটেক। আমি বলব, আরও ৫০টা ভুল আছে বইয়ে। এটা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। আমাদের খুব মন খারাপ হয়েছে। এটা প্রিন্টিং মিসটেক।”
পাঠ্যবই লেখার কাজে দক্ষ লোকের ঘাটতির চিত্র তুলে ধরে এই লেখক বলেন, “একটা বই লেখার পরে যে পরিমাণ চেক করার কথা, সেই পরিমাণ দক্ষ লোক এবং সময় কোনোটাই নেই। সেটা নিয়ে আমরা সমালোচনা করতে পারি। আমরা তো এনসিটিবির স্টাফ না, বাইরের লোক। আমাদের বিশেষজ্ঞ বলা হয়, আমরা লিখে দিচ্ছি। কিছু জিনিস আছে, যেগুলো এনসিটিবি করে। তবে আমরা দায়িত্বমুক্ত হতে চাচ্ছি না।”
পাঠ্যবই প্রস্তুতে যে সক্ষমতায় ঘাটতি আছে, তা স্বীকার করে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, “আমরা যে লজিস্টিকস নিয়ে কাজ করি, সেখানে অনেক সমস্যা রয়েছে। শিক্ষিত কম্পিউটার অপারেটরের অভাব রয়েছে।
“বিজ্ঞান বইয়ে আমরাও ভুল পেয়েছি। টাইপো মিসটেক, আমাদের ইকুয়েশন ফন্ট রয়েছে গণিত ও বিজ্ঞানে। এই ফন্টে কাজ করার মত টাইপিস্ট আমি পুরো বাংলাবাজার খুঁজে পাইনি। এটা আমাদের খুব কষ্ট করে করতে হয়েছে। ছবির মত এঁকে বসিয়ে বসিয়ে এটি করতে হয়। ভালো গ্রাফিক্স করে, এরকম লোকের খুব অভাব। সেরকম দক্ষ লোক নাই। তবে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যথেষ্ট রকমের চেষ্টা করি ভালো কাজ করার।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তারিক আহসানের দাবি, পাঠ্যপুস্তকে সবসময়ই কমবেশি ভুল থাকে, যেগুলো এড়ানো কখনই সম্ভব হয় না। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে এখন আগের তুলনায় ভিন্নভাবে পাঠ্যবই লিখতে হচ্ছে, সেজন্যও ভুল হচ্ছে।
“লেখকদের প্রচুর রিসার্চ ও ইনোভেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে এখন। তাদের অনেক আলোচনা-বিতর্কের মাধ্যমে বিষয়গুলো সাজাতে হয়। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের বই তৈরিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সময় লাগে।”
পাঠ্যবই রচনায় জনবলের ঘাটতিতে ভুল থাকার বিষয়টি ধরা পড়েছে এই অধ্যাপকের ভাষ্যেও।
“এ বছর অষ্টম এবং নবম শ্রেণির দুটো বই একই দলভুক্ত লেখকদের লিখতে হয়েছে। এটাও তাদের অনেক লোড ছিল। এ কারণে প্রুফ রিডিং-এডিটিংয়ে যে সময়ের দরকার হয়, সেটা এবার পাওয়া যায়নি। ফলে কিছু প্রিন্টিং মিসটেক, টাইপো থেকে গেছে।”
এজন্য পাঠ্যবই প্রস্তুতে এনসিটিবির ‘অদূরদর্শিতার চিত্র’ ধরা পড়ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুনের চোখে।
কোভিড মহামারীর পর বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার দীর্ঘদিনের রেওয়াজে ছেদ পড়ে। কয়েকবছর ধরে শেষ সময়ে ছাপা শুরু করায় স্কুলে স্কুলে নিম্নমানের বই যাচ্ছে। সংকট এড়াতে এনসিটিবি কর্মকর্তারা বছরের শুরুতে বই ছাপানো শুরুর পরিকল্পনা জানালেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ফাহিমা খাতুন বলেন, “নতুন শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রে আগের বছর বইগুলো চূড়ান্ত করে যদি ২০২৩ সালের শুরুতে পাবলিকেশনে যাওয়া যেত, তাহলে কিন্তু এতো ভুল হত না। লেখক, এনসিটিবি, শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কমিটি, লেখক পাণ্ডুলিপি দেয়, সেটি বাছাই হয়- সব মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটিতে এবার যতটুকু সময় পাওয়ার দরকার ছিল, তার চেয়ে কম সময় পেয়েছে।”
শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ভুল পাঠ্যবই তুলে দিতে সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে সমাজবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, “লেখক থেকে শুরু করে শিক্ষাক্রমের কমিটি, এনসিটিবির যারা এর সাথে জড়িত, মাউশি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আলাদা আলাদা কমিটি এখানে কাজ করে। প্রতিটি কমিটি যদি সচেতন হয়, যদি বার বার পাণ্ডুলিপিটা দেখে, তাহলে ভুলটা কমে আসবে।”
উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
পাঠ্যবইয়ের ভুল নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শঙ্কায় ফেলেছে অনেক অভিভাবককে। তাদেরই একজন রাজধানীর মালিবাগের সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফাতেমা তুজ জোহরা।
সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে ‘চিন্তায় আছেন’ জানিয়ে এই অভিভাবক বলেন, “গত বছর কতকিছু শুনলাম এটা নিয়ে। এরপরও এবার এত ভুল কেন থাকবে? তারা কি বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না? আমরা অভিভাবকরা তো কিছু বলে লাভ নাই।”
শেরে বাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক উম্মে হাবিবা বলেন, “শুনছি অনেক ভুল বইয়ে। বাচ্চাদের কথা বিবেচনা করে সরকারের উচিত হবে সেগুলোর কারেকশন দ্রুত দেওয়া। এত ভুল থাকলে বাচ্চারা শিখবেটা কি? এর সঙ্গে ওদের ভবিষ্যত জড়িত- আরও যত্নশীল হওয়া উচিত।”
না বুঝে সমালোচনা, বলছেন শিক্ষকরা
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল শাখার ইতিহাসের শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যেটুকু পড়িয়েছেন তাতে বড় কোনো ভুল ধরা পড়েনি।
“ইসরায়েলের যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, ওই অংশ আমরা এখনো পড়াইনি। যে কন্টেন্টগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে- আমার মনে হয় তারা না বুঝেই করছেন। নতুন শিক্ষাক্রমের বই আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে।”
ঢাকার নালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমনা বিশ্বাসও বলছেন, শিক্ষাবর্ষ মাত্র শুরু হয়েছে, আরও পড়ালে বোঝা যাবে। তবে তার কাছে বইগুলো শিক্ষার্থীবান্ধব মনে হয়েছে, সেজন্য ভুল থাকলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত ঠিক করে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
এ বছর মাধ্যমিকের পাঠ্যবই নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। ভুলের পাশাপাশি বইয়ের বিষয়গুলো এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত কিনা তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
সুমনা বিশ্বাস বলেন, “যে ইস্যুগুলোতে কথা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আজকের পৃথিবীতে কথা হবার কথা নয়। শরীফার গল্প নিয়ে সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি না। প্রকৃতিতে যে এই বৈচিত্র্যগুলো রয়েছে, সেগুলো শিক্ষার্থীদের জানানো দরকার।
“স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এগুলো তো শিক্ষার্থীদের আরও ছোটবেলা থেকে জানানো দরকার। বয়ঃসন্ধি শিক্ষার অভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে চাপে পড়ে যায়, সাফার করে। কৈশোরের বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে তাকে না জানালে সে সচেতন হবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমরা বাচ্চাকে জানিয়ে প্রিপেয়ার করে দিচ্ছি। এতে তো কোনো লজ্জা নেই।”
যেসব সংশোধনী আসছে
এনসিটিবির চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলছেন, এখনও মোটা দাগে সংশোধন আসার মত কিছু আসেনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শরীফার গল্পের ক্ষেত্রে যারা বলবেন, বাতিল করে দেন, আমরা তো তাদের সাথে নাই। এখানে দুটি শব্দ নিয়ে একটু কথা হচ্ছে, দেখি কী সাজেশন আসে, সেটা দেখব।
“বিজ্ঞানের ভুলের বিষয়ে বলা হচ্ছে। তবে লেখকরা বলছেন, সেটা কিছুতেই ভুল না।”
প্রাচীন নগরী জেরিকোর মানচিত্র সংশোধন করা হবে জানিয়ে ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “সেসময় লেবানন, সিরিয়া কিছুই ছিল না। ওগুলো পরে নাম হয়েছে। তাহলে ওখানে বলতে হবে বর্তমানের সিরিয়া, বর্তমানের লেবানন। আর ইসরাইলের ওখানে বলতে হবে অবৈধ দখলকৃত ইসরাইল। কারণ বাংলাদেশ ওদেরকে অবৈধ দখলদার হিসেবেই জানে। আমরা তাদের স্বীকৃতি দিইনি।
“এগুলো নিয়ে ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। হয় আমরা ইসরায়েল নামটা একেবারে উঠিয়ে ফেলবে, নয়ত এভাবে লেখব। মতামত এলে তারপর।”
যেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেগুলো সংশ্লিষ্ট লেখকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান।
“এছাড়াও আরেকটি প্যানেল হয়েছে, তাদের কাছে দেব। উনারা যদি পর্যালোচনা করে মনে করেন, সংশোধন প্রয়োজন, তাহলে আমরা অবশ্যই সংশোধন দেব। আমরা ভুল জিনিস শিক্ষার্থীদের পড়াব না।”
শরীফার গল্প নিয়ে বিতর্কের মধ্যে বিষয়টি পর্যালোচনায় ৫ সদস্যের কমিটি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এই কমিটির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, “আমরা তথ্য-উপাত্তের বেশ কিছু ডকুমেন্ট কমিটির সদস্যদের দিয়েছি। তারা সেগুলো বিশ্লেষণ করবেন। প্রথম মিটিংয়ে বিষয়গুলো ভালো করে বুঝে নেবার জন্য কমিটির সদস্যরা ডকুমেন্ট চেয়েছেন।
“হিজড়া কাদের বলা হয়, ট্রান্সজেন্ডার কারা- এসবের বিভিন্ন ডকুমেন্ট আমরা সংগ্রহ করে তাদের দিয়েছি। সেগুলো তারা অ্যানালাইসিস করবেন। সেটা শেষ হলে আমরা আবার বসব এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব।”
শরীফার গল্প নতুন করে লেখা হতে পারে বলে আভাস দেন তিনি। এছাড়া ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের মানচিত্রে ইসরায়েল বিষয়ক ভুলটি কীভাবে হল, সেটাও দেখা হচ্ছে বলে জানান মশিউজ্জামান।
নবম শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের অনেক অংশ ওয়েবসাইট থেকে হুবহু তুলে দেওয়ার বিষয়ে সমালোচনা চলছে।
এর মধ্যে বইটির প্রথম অধ্যায়ের নিউটনের প্রথম সূত্রের ‘স্থিতি ও গতি জড়তা’ বোঝানোর জন্য চলন্ত গাড়ির উদাহরণও রয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান বলেন, “আমি ৭৮ সালে যখন পদার্থবিজ্ঞান পড়েছি, তখনও আমি এই উদাহরণ পড়েছি। অথচ বলা হচ্ছে, এটি মিশরের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। যারা বলছে, এটা হুবহু কপি করা, সেটা ঠিক নয়। এই উদাহরণ পৃথিবীর সব জায়গাতে পাওয়া যাবে। এটা মিশরের কোন সাইটের উদাহরণ নয়। আশির দশকে এটা যখন বাংলাদেশের বইয়ে ছিল, তখন তো মিশরের ওয়েবসাইট ছিল না। যারা এগুলো নিয়ে সমালোচনা করছে, তাদের উদ্দেশ্যই হল বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এটি বলছে।
"আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, পৃথিবীর সব দেশের ওয়েবসাইটে স্থিতি ও গতিজড়তায় এই উদাহরণটি ব্যবহার করা হয়। সহজে বোঝার জন্য এই উদাহরণটি দেওয়া হয়।"
কিছু ভুল নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, "প্রেসে প্রিন্টিং মিসটেক হয়ে থাকে। তবে, আমার প্রশ্ন, হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর অংশটি অন্য বইয়ের সঙ্গে না গিয়ে ইসলাম শিক্ষার বইয়ে কেন গেল? এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।"
সব ভুলের তালিকা করা হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, "আশা করছি, এ মাসের শেষের দিকে একটি নির্দেশনা আমরা স্কুলগুলোতে পাঠাতে পারব। প্রাথমিকভাবে তথ্যগত কোনো ভুল থাকলে আমরা এখনই সংশোধনী পাঠাব।"
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, বছরের প্রথম তিন মাস কী ভুলগুলো হয়েছে তা দেখার পাশাপাশি যেসব বিষয়ে সমালোচনা আসছে তা যাচাই করে দেখা হবে।
তার দাবি, জেরিকো নগরীর মানচিত্রের ভুল হয়েছে গ্রাফিক্সের কাজের সময়। ওখানে ‘গাজা’ লেখা থাকলেও টাইপিস্টরা ‘গাজা’র জায়গায় ‘গাম্বিয়া’ বসিয়ে দিয়েছে।
অনেকক্ষেত্রেই ভুলের নামে ‘অপপ্রচার’ চলছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক বলেন, “শরীফার গল্প নিয়ে কারণ ছাড়াই বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞান বই নিয়ে কিছু লেখালেখি হচ্ছে। গতিজড়তার সূত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে- উদাহরণটি কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এটা আসলে যিনি তুলেছেন, তার বোধগম্যতার সীমাবদ্ধতা।
“কারণ সারা পৃথিবীতে নিউটনের সূত্র আবিষ্কারের পরে মানুষ একইভাবে পড়ালেখা করেছেন। এটাকে কপি-পেস্ট বলা মানে তিনি এটা হয় বোঝেন না বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা।”
অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, “শিক্ষাক্রম মূল্যায়নে মানুষের ফিডব্যাক খুবই জরুরি। কিন্তু যখন সঠিক ফিডব্যাক না দিয়ে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়, তখন মানুষের মনোযোগ অন্য দিকে চলে যায়। গত কয়েকবছর ধরেই আমরা এগুলো দেখছি, যেটার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছি।”
পুরনো খবর: