অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা এগিয়ে আসায় কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বহাল থাকছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বরের পরিবর্তে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মোংলা সমুদ্রবন্দরের জন্য থাকছে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় আরও শক্তি সঞ্চয় করে কক্সবাজারের ৬৩০ কিলোমিটার কাছে চলে আসার পর শনিবার দুপুর আড়াইটায় আবহাওয়া অধিদপ্তর সংকেত পুনর্বিন্যাস করে নতুন বুলেটিন দিয়েছে।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এর আগেই জানিয়েছিলেন, কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত আসছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার দুপুর ১২টায় কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ এখন ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার আকারে ১৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ আগের মতোই কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলের দিকে রয়েছে। এটি রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
তবে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপর দেখা দিতে পারে বলে বুলেটিনে জানান হয়।
উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুরের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এজন্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছধরা নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বলছে, মোখা এরই মধ্যে চরম প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে, যা সুপার সাইক্লোনের আগের ধাপ। এটি ৮ কিলোমিটার বেগে এগোচ্ছে।
ঝড়টি সাগরে শক্তি আরও বাড়ালেও উপকূলে আঘাত হানার আগে এর তীব্রতা কমে আসবে বলে আভাস দিচ্ছে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ। তাদের বুলেটিনে বলা হয়েছে, রোববার দুপুরে ১৫০-১৬০ কিলোমিটার বাতাসের শক্তি নিয়ে এটি উপকূলে আঘাত হানবে।
সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এনামুর বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টি নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এটি সুপার সাইক্লোন হতে পারে, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছি যে এটির সুপার সাইক্লোন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
“সুপার সাইক্লোন হতে হলে ২২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় গতিবেগ হতে হবে। এর মধ্যে এখন বাতাসের গতিবেগ আছে ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। এখন এটাকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বা সিভিয়ার সাইক্লোন হিসেবে অভিহিত করছি।”
ঝড়ের গতি নিয়ে তিনি বলেন, “এটি গতকাল যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার, সেটাও কমে এসেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক জানালেন, আট কিলোমিটার গতিতে এটা এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আমরা মনে করছি এটা আঘাত হানার সময়টা একটু পিছিয়ে যেতে পারে।”
বাংলাদেশের স্থলভাগে তাপপ্রবাহ বয়ে চলার মধ্যে সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগর ও এর সংলগ্ন আন্দামান সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়।
তখন থেকে এর আরও ঘনীভূত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। মঙ্গলবার এটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ এবং পরে নিম্নচাপে পরিণত হয়। বুধবার এটি গভীর নিম্নচাপ হয়েই সাগরে ছিল। বৃহস্পতিবার তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। একই দিনে তা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।
এসকাপের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এটি ইয়েমেনের দেওয়া ‘মোখা’ নাম পায়।
মোকাবেলায় ‘আত্মবিশ্বাসী’ মন্ত্রণালয়
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সবশেষ প্রস্তুতি নিয়েও বিস্তারিত জানিয়ে বলা হয়, ঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় মন্ত্রণালয় আত্মবিশ্বাসী।
“যথাযথ আইনি ও নীতিগত কাঠামো, উপযুক্ত পরিকল্পনা, প্রশিক্ষিত ও প্রস্তুত জনবল, যথেষ্ট মানবিক সহায়তা, নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পাশাপাশি আগাম সতর্কতার কারণে বিগত সময়ের মতো আমরা এই ঘূর্ণিঝড়টিও সফলভাবে মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাসী।”
শুক্রবার রাত থেকেই কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলায় বিপদাপন্ন জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা শুরু হয়েছে বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
সবচেয়ে বিপদের সম্মুখীন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রায় ৮৫০০ মানুষকে ‘সুপার সাইক্লোন’ মোকাবেলায় সক্ষম ৩৭টি অবকাঠামোয় নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
প্রয়োজন হলে সেখানকার মানুষকে উদ্ধার করে টেকনাফে নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী ও কোস্ট গার্ড প্রস্তুত আছে বলে জানান হয়েছে।
অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার কথা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলায় স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৩০টি, ধারণক্ষমতা ৫ লাখ ৭০ হাজার ৮৫০ জন এবং কক্সবাজার জেলায় স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৭৬টি, ধাণক্ষমতা ৫,১০ হাজার জন। এর বাইরেও চট্টগ্রাম জেলায় আরও ৫০০টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য ও ওষুধের প্রস্তুতি
মানুষকে নিয়ে আসার আগে আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলায় ৫০ মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ টাকা, ৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন ড্রাই কেক, ৩ দশমিক ৪ মেট্রিক টন টোস্ট বিস্কুট, ৩০০ প্যাকেট ওরস্যালাইন, ৬০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছে। কক্সবাজার জেলায়ও দেওয়া হয়েছে এমন বরাদ্দ।
এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় ৬৮৪ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা এবং কক্সবাজার জেলায় ৪৯৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা মজুদ আছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।