স্মরণানুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে গবেষক তপন বাগচী বলেন, বেবী মওদুদকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
Published : 25 Jul 2023, 08:23 PM
প্রয়াত বেবী মওদুদের সাহিত্যিক, রাজনীতিক, গবেষকসহ বহুমুখি সৃজনশীল গুণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে 'প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী' পরিচয়ের কারণে। এসব বহুমুখি গুণের কারণে তাকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক দেওয়া উচিত বলে এক স্মরণসভায় জানালেন বক্তারা।
মঙ্গলবার বেবী মওদুদের নবম প্রয়াণবার্ষিকীতে আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গ তোলেন গবেষক তপন বাগচী।
আগামী প্রকাশনী আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠানটি হয় বেলা ৩টায় বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে। সহযোগিতায় ছিল বাংলা একাডেমি।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই চিরবিদায় নেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ বেবী মওদুদ।
গবেষক তপন বাগচী বলেন, “বেবী মওদুদকে সবাই যেভাবে দেখি 'প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী'। কিন্তু তার সাহিত্যিক পরিচয়টা আড়ালেই থেকে যায়। বেবী মওদুদ সাহিত্যিক, মানুষের সেবা করতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন লোভ-লালসার উর্ধ্বে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছিল তার সখ্য, তিনি চাইলে অনেক কিছুই পেতে পারতেন। কিন্তু সেটি তিনি করতেন না। ব্যক্তিগতভাবে কোনো সুবিধা নিতেন না।”
“প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী বলে তার সেই সাহিত্যিক, গবেষক গুণটি হয়তো আড়ালেই থেকে যায়। তাকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার উদ্যেগও এখনো নেওয়া হয়নি। সেই উদ্যেগটি নেওয়া উচিত।”
একই আহ্বান জানান বেবী মওদুদের ছোট ভাই আবু রায়হান আজিমুল হক।
“বড় আপা অনেক কিছুই করেছেন। সাহিত্য, গবেষণা, সাংবাদিকতা, রাজনীতি- কিন্তু তিনি বড় কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি। এটা নিয়ে সবাইকে ভাবার জন্য অনুরোধ করব,” বলেন তিনি।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ফকরুল আলম। আলোচক ছিলেন সুভাষ সিংহ রায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না, সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম, আবু রায়হান আজিমুল হক।
শুরুতেই বেবী মওদুদের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করা হয়। অনুষ্ঠানে তার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত 'কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া' গেয়ে শোনান বেবী মওদুদের পুত্রবধূ কমলিকা চক্রবর্তী।
স্বাগত বক্তব্যে আগামী প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী ওসমান গনি বলেন, “নিরহংকারী বেবী আপা সব সময় আড়ালে থেকে আমাদের সামনে এগিয়ে দিতেন। আমরা যেকোনো সংকটে বেবীর আপার কাছে গেলেই সমাধান পেতাম। প্রকাশকদের নানা সংকটে উনাকে কাছে পেয়েছি। বেবী আপার মতো একজন মানবিক মানুষের আরও অনেক দরকার ছিল। আমি আনন্দিত হয়েছি, বাংলা একাডেমি বেবী মওদুদ রচনাবলী প্রকাশের উদ্যেগ গ্রহণ করেছে।”
মূল প্রবন্ধে উপস্থাপনে তপন বাগচী বলেন, “স্কুলে পড়ার সময়ই বেগম রোকেয়ার জীবনী বেবী মওদুদকে অনুপ্রাণিত করেছে। ছোটবেলা থেকে বেবী মওদুদ সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তিনি ডাকযোগে লেখা পাঠাতেন কচিকাঁচার আসরে। কলকাতার 'শিশুসাথী' পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো। তখন শিশুসাথী পত্রিকায় লেখা ছাপা হলেই অনেকে সাহিত্যিক মর্যাদা পেতেন। বেবী মওদুদের লেখা কিন্তু সেই পত্রিকায় ছাপা হতো। উনি তখন থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত।
“পরবর্তীতে তিনি নিজে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন, সংসদ সদস্য হয়েছেন। আবার রাজনীতির ইতিহাসও তিনি লিখে গেছেন। তিনি বহুমুখি কাজ করেছেন। শিশুদের জন্য লিখেছেন, নারী পাচার নিয়ে লিখেছেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লিখেছেন, রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। নানাভাবে তার কাজ আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। তার সবচেয়ে বড় কাজের একটি হচ্ছে 'বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী'।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ফকরুল আলম বলেন, “বেবী মওদুদ আপার সাথে ২০০৬ সালে আমার পরিচয় হয়। এর আগে বেবী আপার লেখা পড়েছি, কিন্তু সামনাসামনি সেদিনই কথা হয়। তখন বঙ্গবন্ধুর বই ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। এটি আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য। এত বড় একটা কাজে যুক্ত হতে পেরেছিলাম। সেই কাজটি করতে গিয়েই বেবী আপাকে কাছ থেকে দেখেছি। তখন শামসুজ্জামান ভাই, বেবী আপা, আমি এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিলে এই কাজ নিয়ে অনেক সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি। বেবী আপা সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, কিন্তু তার সহজ জীবন দেখে মুগ্ধ হতাম।”
সুভাষ সিংহ রায় বলেন, “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম রূপকার ছিলেন বেবী মওদুদ। খুবই দুঃখজনক যে, বঙ্গবন্ধুপ্রেমী অনেক লোকের কাছ থেকেই বেবী আপা কষ্ট পেয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যার সাথে বেবী আপার যে বন্ধুত্ব সেটি আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। বেবী আপা আমাদের জন্য অনেক করেছেন, কিন্তু আমরা তার জন্য কিছুই করতে পারিনি।”
সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম বলেন, “আমি খুব ছোটবেলা থেকেই বেবী আপাকে চিনি। বেবী আপা তখন ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করতেন। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হতো না। আশির দশকে বেবী আপা একদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন, আমার মায়ের সাক্ষাৎকার নিতে। আমার মা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পরে আমি যখন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যার সাথে সব সময় দেখতাম বেবী আপাকে। তার সাদাসিধা জীবনযাপন দেখে মুগ্ধ হতাম “
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না বলেন, “একটা দেশের জন্ম হওয়ার পর সেই দেশকে প্রগতিশীল পথে পরিচালনার জন্য যখন যেখানে প্রয়োজন, সেখানে বেবী তার ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সে ছিল প্রচারবিমুখ। সে নিরবে তার কাজটুকু করে গেছে। নিজেকে গৌণ করে দেশ, মানুষ, সাহিত্যকে মুখ্য করে জীবন পার করেছে বেবী।”
সভাপতির বক্তব্যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মাঝে আমি বেবীকে দেখতে পাচ্ছি। বেবীকে প্রথম দেখেছিলাম মিছিলে। আজকে বেবীকে নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেটিকে যদি আমরা ধারণ করতে পারি, তবেই আমরা বেবীর স্বপ্নটাকে ধারণ করতে পারব। বেবী মানে সংঘবদ্ধতা, বেবী মানে নান্দনিক বাংলাদেশ। বেবীর যে বিশুদ্ধতা, তা ছড়িয়ে যাক।”
সবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন বেবী মওদুদের ছেলে রবিউল হাসান অভি।
তিনি বলেন, “সেই ছোটবেলা থেকেই বইমেলায় আসার শুরু, সেই থেকে বাংলা একাডেমিতে আসা হতো। সেই আসার শুরু মূলত মায়ের কারণেই। এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।”
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’সহ বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে বেবী মওদুদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বেবী মওদুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন, কলকাতায়। তার বাবা আবদুল মওদুদ ছিলেন একজন বিচারপতি। আর মায়ের নাম হেদায়েতুন নেসা। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
১৯৬৭ সাল থেকে সাংবাদিকতায় জড়িত বেবী মওদুদ দৈনিক সংবাদ, বিবিসি, দৈনিক ইত্তেফাক, বাসস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় দীর্ঘদিন কাজ করার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার দিনগুলোতেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন বেবী মওদুদ। ১৯৭১ সালে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার আগে ১৯৬৭-৬৮ সময়ে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধপত্র সংগ্রহ, নির্যাতিত নারীদের আশ্রয় এবং বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন বেবী মওদুদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।
নবম জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং লাইব্রেরি কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
গবেষণা গ্রন্থ, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, জীবনীগ্রন্থসহ সাহিত্যের নানা অঙ্গনে বিচরণ করেছেন বেবী মওদুদ।