“এতো ঘণ্টা পরও সিটি করপোরেশন থেকে কেউ রাস্তা থেকে ইটপাটকেল সরাচ্ছে না,” বলেন কাকরাইলের রশিদ আলী।
Published : 29 Oct 2023, 12:15 AM
বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে শনিবার প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার সহিসংতার পর রাজধানীর পরিস্থিতি থমথমে। সড়ক ফাঁকা, বাস প্রায় নেই বললেই চলে; সংঘর্ষের পর হরতালের ঘোষণায় বেড়েছে উৎকণ্ঠা।
ঢাকার কাকরাইল মোড়ে সংঘর্ষের কারণে নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা এই হরতাল ডেকেছে দলটি।
শনিবার দুপুরে সমাবেশস্থল থেকে হরতালের এ ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে গণতন্ত্র মঞ্চ ও জামায়াতে ইসলামীও আলাদাভাবে হরতাল ডাকে।
দুপুরে সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়ার যেমন ঘটনা ঘটেছে, তেমনই হাসপাতালে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্সে পোড়ানোর ঘটনাও দেখেছে ঢাকা।
দৈনিক বাংলা মোড়ে এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকার ওয়ার্ড পর্যায়ের এক যুবদল নেতার মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যেই রাতের ঢাকার নিরাপত্তায় ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতি প্লাটুনে গড়ে ৩০ জন সদস্য থাকেন।
দিনের সংঘাতের পর রাতে আরামবাগ মোড়, ফকিরাপুল এলাকার প্রধান সড়কগুলো জনশূন্য, যেন ভুতুড়ে রূপ পেয়েছে। সড়ক জুড়ে ইট-পাটকেল, গাছের ডাল, ভাঙা কাচের টুকরো, কাঁদুনে গ্যাসের ক্যানিস্টার, শটগানের গুলির খোসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ ঘটা বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকার বাতাসে এখনও তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। এ পথে চলাচলকারীরা নাক চেপে চলাচল করেছেন। সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পোড়া ধ্বংসাবশেষ, ছাই।
সড়ক বিভাজকগুলো ভাঙা। এর মধ্যেই এলোমেলোভাবে চলছে রিকশা। বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বালানোর দাগ দেখা যায়, রাত ৮টার দিকেও কোথাও কোথাও ধোঁয়া বের হচ্ছিল। বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন সড়কের দু'পাশে। পড়ে থাকা ইটের টুকরো দেখলে মনে হয় যেন ইট বৃষ্টি হয়েছে।
কালভার্ট রোড এলাকায় বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সেখানে অনেক জায়গায় আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছিল রাত ১০টার দিকেও। প্রধান সড়কগুলোতে অস্ত্র হাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। পথ চলতি মানুষেকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছে পুলিশ সদস্যরা, কেউ দাঁড়িয়ে জটলা পাকালে ধমকে সরিয়ে দেওয়া দিচ্ছে।
অবশ্য ফকিরাপুল থেকে কালভার্ট রোডের গলিপথগুলোর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। খাবারের দোকানগুলোর জটলায় ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ নিয়ে চলছে আলোচনা। রোববার হরতালে কী ঘটতে পারে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন মানুষ।
ফায়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকায় শনিবার ১৫টি জায়গায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আতঙ্কে সন্ধ্যার আগেই ঢাকার অন্যান্য এলাকার রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়েছে।
সাধারণ সময়ে সন্ধ্যার পর জাহাঙ্গীর গেট-বিজয়সরণী-কারওয়ানবাজার রুট ধরে ইস্কাটন আসতে অন্তত ৪৫ মিনিট লাগে। ফাঁকা রাস্তায় শনিবার ওই পথক ১০ মিনিটেও যাওয়া গেল। যাত্রা পথে তিন-চারটা বাস ছাড়া গণপরিবহন তেমন দেখা গেল না। কিছু সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল আর প্রাইভেট কার চলতে দেখা গেল। রাস্তায় মানুষও অনেক কম।
শনিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে মহাখালীর তিতুমীর কলেজ গেইট থেকে মোটর সাইকেলে আগারগাঁও যেতে লেগেছে মোটে ৮ মিনিট। পথে আমতলী, মহাখালী রেল ক্রসিং, জাহাঙ্গীর গেইট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা আগারগাঁও কোথাও কোন সিগন্যালে পড়তে হয়নি। এই রাস্তায় কোনো বাস বা মিনিবাস চোখে পড়েনি। রাস্তায় রিকশা, মোটরসাইকেল আর কার-জিপ কেবল দেখা গেছে।
রাত ৯টার দিকে নয়া পল্টন, বেইল রোড, মালিবাগ, শান্তিনগরে গিয়ে দেখা গেল, যানবাহন একেবারেই কম। প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং বিচারপতিদের বাসভবনে সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা বেড়েছে। কাকরাইলের মোড়ে বসানো হয়েছে চেক পোস্ট।
নয়া পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের কলাপসিবল গেইট ভেতর থেকে তালা দিয়ে বন্ধ। নিরাপত্তা কর্মী জোনায়েদ জানান, অফিসে কেউ নেই। নেতারা সন্ধ্যায় চলে গেছেন।
বিএনপি অফিসের সামনের খোলা ট্রাকগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই ট্রাকের ওপর মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল মহাসমাবেশের জন্য।
বিএনপি অফিসের কাছে একটি গলিতে চায়ের দোকানদার নুরু মিয়া বলেন, “পুরো এরিয়ায় এখন মানুষজন নেই বলে মনে হচ্ছে। রাস্তায় রিকশাও চলছে না। কিছুক্ষণ পর পর বিজিবির গাড়ি টহল দিচ্ছে। নয়া পল্টন ও কাকরাইল মোড়ে সব সময় পুলিশ থাকে। এখন আপনি দেখবেন কোনো পুলিশও নাই।”
শান্তিনগর ও কাকরাইলের সামনে সবসময় যানবাহনের জটলা থাকলেও শনিবারের রাতের দৃশ্য ভিন্ন। মাঝে মধ্যে কিছু প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে। দুই একটা অটোরিকশ ও রিকশা দেখা যায়।
কাকরাইলের মোড়ে রশিদ আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, “মানুষজন ভয়ের মধ্যে আছে। দেখেন ঘটনার এত ঘণ্টা পরও সিটি করপোরেশন থেকে কেউ রাস্তা থেকে ইটপাটকেল সরাচ্ছে না।”
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাকরাইলে দলটির কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ বাধে।
ঘটনাস্থলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরপর দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে। পরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং তা নয়া পল্টন, ফকিরাপুল ও রাজারবাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
কাকরাইল চার্চের সামনে একটি পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিএনপি কর্মীরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে।
সংঘর্ষের মধ্যে আহত প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্যকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ দিন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ডজন খানেক সংবাদকর্মীও আহত হন, যারা ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি আছেন।