অন্তত অর্ধশত আসনে হামলা, মারামারি, গোলযোগ ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ঘটনা বর্জনের ভোটেও উত্তাপ ছড়িয়েছে।
Published : 05 Jan 2024, 12:46 AM
কড়াকড়ির মধ্যেই আচরণবিধি ভাঙার অহরহ ঘটনা ঘটল, প্রার্থিতাও বাতিল হলো একজনের; আর প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টিতে বিএনপির বজর্নের মধ্যেও সরব ছিল ভোটের মাঠ। প্রচারের সেই পর্ব পেরিয়ে এখন ভোটের অপেক্ষা।
প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে ১৮ দিন ধরে অনবরত প্রচারের পর মনোযোগ এখন কেন্দ্রে ভোটার আনা আর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা দেশজুড়ে শান্তি শৃংঙ্খলা ঠিক রাখার কাজে নেমে গেছেন। নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতির কার্যক্রম শেষ করেছে।
রোববার ভোটের আগে প্রচার শেষে এখন ভোটের বাকি প্রস্তুতি নিতে দুই দিন সময় পাচ্ছেন ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী। পোলিং এজেন্ট চূড়ান্ত করা থেকে কর্মীদের ভোটের দিনের আগে ও পরের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যালেটে জনগণের রায় কী হবে সেই প্রতীক্ষায় সময় কাটবে তাদের। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আরেক পক্ষের নজর থাকছে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণেও।
ভোট বর্জন করে বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যেই শতাধিকের বেশি আসনে স্বতন্ত্রদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ অনেক স্থানে নির্বাচনে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এরপরও অধিকাংশ এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রচার চললেও অন্তত অর্ধশত আসনে হামলা, মারামারি, গোলযোগ ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ঘটনা ভোটের আলোচনাকে সরব রেখেছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সব ধরনের প্রচার শেষ হচ্ছে শুক্রবার সকাল ৮টায়।
নির্বাচন কমিশন বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; বড় ধরনের গোলযোগের শঙ্কা নেই। শান্তিপূর্ণ ভোটের সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
একজন নির্বাচন বিশ্লেষকও প্রচার পর্ব ভালোভাবে উৎরানো গেছে মন্তব্য করে বলেছেন, এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।
বৃহস্পতিবার প্রচার শেষের আগের সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে সবাইকে ভোট দিতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, এমন যে কোনো ধারণায় প্রশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন।
ভোটের আগে ও পরে বিএনপির ৪৮ ডাকা ঘণ্টা হরতালের পরও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা রেখে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কোনো উদ্ভট ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং ইন্ধন যোগাবেন না।”
দলের প্রার্থী ১৫৩৬, স্বতন্ত্র ৪৩৬
একজন প্রার্থীর মৃত্যুতে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হবে ২৯৯ আসনে। বিএনপিবিহীন এ ভোটে থাকছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল, যাদের প্রার্থী রয়েছে ১ হাজার ৫৩৬ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন ৪৩৬ জন, যাদের অন্তত তিন ভাগের এক ভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পদাধিকারী।
দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে টানা ১৮ দিন ধরে চলেছে অনেকটাই জমজমাট প্রচার। এখন পর্যন্ত নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন ও অপরাধ সংক্রান্ত ৬০০টি অভিযোগ এসেছে।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে আসার নানা উদ্যোগ ও প্রার্থীদের সব ধরনের প্রচেষ্টার মধ্যে ভোট বর্জনে আহ্বান জানিয়ে বিএনপি ভোটারদের কেন্দ্রে আসার নিরুৎসাহিত করছে এবং হরতালও ডেকেছে।
এরমধ্যেই ভোটের প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন। প্রচারের শেষ দুই দিনে এলাকায় এলাকায় পৌঁছে গেছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। নির্বাহী হাকিম ও বিচারিক হাকিম রয়েছেন তিন সহ্রস্রাধিক।
এবার ভোটের দিন সকালে ব্যালট যাবে বেশির ভাগ কেন্দ্রে। শুধু দুর্গম কেন্দ্রে কঠোর নিরাপত্তায় যাবে শনিবার বিকালে। রোববার ভোর ৬টার মধ্যে পৌঁছবে বাকি ৩৯ হাজার ৬১ কেন্দ্রে।
জেলায় জেলায় পৌঁছে গেছে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনি সামগ্রী। জরুরি প্রয়োজনে পরিবহন কাজের জন্য প্রস্তুত রয়েছে হেলিকপ্টার।
‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ’
প্রচারপর্ব ভালোভাবে শেষ হয়েছে বলেও মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।
আগের নির্বাচনগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ মূল্যায়ন করতে গেলে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের প্রচারও ছিল শান্তিপূর্ণ। ২০১৪ সালে বিএনপি বর্জন করেছিল, পরিস্থিতিও সহিংস হয়েছিল। ২০১৮ সালে বিএনপি এলেও নানা ধরনের গোলযোগের ঘটনা ঘটেছে। বলা যায়, এবার সহিংস ঘটনা ২০০৮ সালের চেয়ে বেশি হলেও ২০১৮ সালের চেয়ে কম।
প্রচারের পর্ব নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আব্দুল আলীম বলেন, এবার প্রচারের সময় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকের মধ্যে বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনি ক্যাম্প ভাঙচুর, নিজেদের মধ্যে মারামারি ও ভয়ভীতির ঘটনা রয়েছে। আচরণবিধিও লঙ্ঘের মধ্যে ইসিও পদক্ষেপ নিয়েছে। ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগের নানা উদ্যোগও রয়েছে।
ভোটে না থাকা দল বিএনপি হরতাল ডেকেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যে এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।
সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলেও ভোটের দিনসহ সামনের কয়েকটি দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
আব্দুল আলীম বলেন, “যা হওয়ার হয়েছে, অনেক দল এসেছে, কিছু দল আসে নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এখন একার পক্ষে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করবে না; সরকারের জন্যও এটা চ্যালেঞ্জ। এখন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে ভালো পদক্ষেপ নিতে হবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, প্রায় আট লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোটের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। তারা ভোট গ্রহণ করবেন। আরও এক লাখ স্টান্ডবাই থাকবে। নয় লাখ আমাদের প্রস্তুত আছে।
আইন শূঙ্খলা রক্ষাকারীর যে বাহিনীগুলো আছে সব মিলিয়ে আনসার, বিজিবি, পৃলিশ, র্যাব, আর্মি, নেভি ও কোস্টগার্ড সব মিলিয়ে আরও আট লাখ আইন শূঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে আছে, মাঠে থাকবে, ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত।
তিনি বলেন, “এটা বেশ বড় একটি কর্মযজ্ঞ। এছাড়া আমরা আইন শূঙ্খলা রক্ষা করার জন্য আরও তিন হাজার ম্যাজিস্ট্রেট এবং জাজেস ওরাও কিন্তু মাঠে আছে এবং থাকছে।”
আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বুধবার ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, “এ পর্যন্ত মাঠে যে পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অবস্থা, তা এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এখন পর্যন্ত নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো আশংকা করছেন না। তবে যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে এজন্য প্রত্যেকেই তারা তাদের নিজ নিজ গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আরো সক্রিয় রাখবে, যাতে কোনো ধরণের ঘটনা ঘটার আগেই তা নিস্ক্রিয় করা সম্ভব হয়।”
প্রচার শেষে মিছিল-শোভাযাত্রায় কড়াকড়ি
রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট চলবে। ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলের প্রচারণা শেষ হবে শুক্রবার সকাল ৮টায়।
ভোট হবে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারে। এদিন ২৯৯ আসনে ভোট হবে। নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় সেখানে পরে ভোট হবে।
ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে ভোটের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা নির্বাচনি এলাকায় সভা, সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত সভা, সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না।
মোটরসাইকেল চলবে না তিনদিন
নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে ৭২ ঘণ্টা দেশজুড়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যা শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হবে।
একই সঙ্গে ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচলও বন্ধ থাকবে শনিবার মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন রোববার মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলেছে, শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) মধ্যরাতে শুরু হয়ে ভোটের পরদিন সোমবার (৮ জানুয়ারি) মধ্যরাত পর্যন্ত বাইক চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে।
তবে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা জরুরি কোনো কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল চলতে পারবে-এজন্য রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন নিতে হবে এবং স্টিকার প্রদর্শন করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকদের বহনকারী যানবাহনের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন, ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন চলাচলে কোনো বাধা নেই।
এছাড়া বিদেশ থেকে দেশে আসা এবং বিদেশে যাওয়া ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে বহনকারী যানবাহন চলাচলে বাধা থাকবে না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উড়োজাহাজের টিকেট দেখাতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে দূরপাল্লার যাত্রী বহনকারী এবং দূরপাল্লার যাত্রী হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে যাতায়াতের জন্য যে কোনো ধরনের যানবাহন চলাচলেও কোনো বাধা থাকছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য একটি এবং প্রার্থীর এজেন্টদের জন্য একটি গাড়ি রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষ স্টিকার দেখিয়ে চলাচল করতে পারবে।
আরও পড়ুন
ভোটে প্রার্থী এখন ১৯৭০ জন, দল ২৮টি
ব্যালট পেপার বিতরণ শুরু, প্রথম দিন গেল ১৩ জেলায়
সহিংসতা খুব বেশি হয়নি, দাবি সিইসির
ভোট ঘিরে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক বিএনপির
ভোটারদের চাপ প্রয়োগ, সহিংসতার বিষয়ে জানতে চাইলেন কূটনীতিকরা
ভোটকেন্দ্রে গেলে ভয় নেই, এমন নিশ্চয়তা নিরাপত্তা বাহিনীর: ইসি