দুর্গাপূজায় সহিংসতা: বিচার হবে কবে?

জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়া সেই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ১২৪টি মামলা হলেও কোনটিরই বিচার শুরু হয়নি এখনও।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2022, 07:33 PM
Updated : 1 Oct 2022, 07:33 PM

ক্ষত কাটিয়ে আবার সেজেছে মণ্ডপ, উৎসবের রঙ ছড়াতে এল বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা; তবে আগেরবারের সহিংসতার পেছনের ব্যক্তিদের বিচার এতদিনেও শুরু না হওয়ায় আক্ষেপের সুর কাটেনি এখনও।

জেলায় জেলায় মণ্ডপ, মন্দির আর হিন্দুবসতিতে ভাঙচুর ও হামলা, সংঘর্ষ আর প্রাণহানির ঘটনায় শতাধিক মামলার অনেকগুলোর কূল কিনারা বাকি। অভিযুক্তদের নামে অভিযোগনামা তৈরির কাজও শেষ হয়নি বেশ কয়েকটিতে। তদন্তেই দীর্ঘসময় লেগে যাওয়ায় এরই মধ্যে আসামিদের বেশির ভাগই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন বলে তথ্য মিলছে।

এক বছর পেরিয়ে গেলেও চারটি মহানগর ও ২৮টি জেলায় ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক সেই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১২৪টি মামলার কোনটিরই বিচার শুরু হয়নি; এখনও তদন্তের পর্যায়েই রয়েছে বেশির ভাগ মামলা।

সেসময় আট জেলায় দায়ের ২৬টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট (পিবিআই)। এসব মামলায় গ্রেপ্তার ১৭২ জনের মধ্যে ১২৮ জন গত এক বছরে জামিনে বেরিয়ে গেছেন বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। আর ১৪টির তদন্তে শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

আরেকটি উৎসব শুরুর আগে সনাতন এই ধর্মের নেতারা বলছেন, হামলাকারীরা বিচারের আওতায় এলে তারা স্বস্তিতে থাকতেন।

Also Read: দুর্গাপূজা: আনন্দের উৎসবে ভয়ের মেঘ সরবে কবে?

দুর্গাপূজার গতবারের আয়োজন বিষাদে রূপ নেয় কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর অস্থায়ী মণ্ডপে কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবে হামলা আর সংঘাতের ঘটনায়।

কয়েকদিন ধরে চলা সেই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভয়াল স্মৃতি পেছনে ফেলে এবার উৎসবের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে আনন্দের রেশ ছড়াতে শুরু করেছে। স্থানীয় প্রশাসন আর পুলিশের আশ্বাসে কুমিল্লার সেই নানুয়ার দীঘির পাড়ের মন্দিরসহ দেশজুড়েই চলছে উৎসবের আয়োজন।

তবে সেই ক্ষত যেমন পুরোপুরি শুকোয়নি, তেমনি অনেকের ভয়ও দূর হয়নি। শঙ্কাও যে পুরোপুরি কাটেনি সে কথা পূজার শুরুর আগে একাধিকবার তুলে ধরেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।

সব মণ্ডপে সার্বক্ষণিক পাহারার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ সতকর্তা বজায় রাখা এবং গোয়েন্দাদের তৎপর থাকার কথা জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ভয়কে দূরে ঠেলে এবার দেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। কোভিড সংক্রমণকে ঘিরে বিধিনিষেধ না থাকায় দর্শনার্থীদের সমাগম বেশি হবে বলেও মনে করছেন সনাতন নেতারা।

কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু গেল বছরের ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেই ভাবতে চান।

তিনি বলেন, “গত বছরের ওই ঘটনায় আমাদের উৎসব পরিণত হয়েছিল বিষাদে। নিরাপদে উৎসব পালন করতে পারব বলে এবার আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের আশ্বাস পাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে খুব বেশি আতঙ্ক না থাকলেও বাস্তবতায় বলতে গেলে- পুরোনো সেই ক্ষত এখনও শুকোয়নি।”

সবগুলোর মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া এতদিনেও শেষ না হওয়ার বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, এই ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া যখন বিলম্বিত হয় তখন হামলাকারীদের কাছে এমন কোনো বার্তা যায় না যাতে মনে হয় সরকার শক্ত কোনো অবস্থানে রয়েছে।

এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

মামলাগুলোর তদন্তের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশনস) আলী আহমেদ খান অধিকাংশ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা জানালেও বিস্তারিত তথ্য দেননি।

তবে গতবারের পেক্ষাপটে এবার পূজা আয়োজনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা পুলিশ সদর দপ্তর নিয়েছে বলে জানান তিনি।

গত বছর ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘীর পাড়ে পূজামণ্ডপটিতে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা ছড়িয়ে পড়েছিল চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনী, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, মুন্সীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বরিশালসহ কয়েকটি জেলায়।

এসব জেলায় মন্দির-মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়, আগুন দেওয়া হয় হিন্দুদের বাড়ি ও দোকানপাটে। হামলা ঠেকাতে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে প্রাণহানীও ঘটে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট থানায় এসব ঘটনায় ১২৪টি মামলায় নাম উল্লেখ করে ১ হাজার ৫৫৯ জনকে আসামি করা হয়; এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামি আরও প্রায় ২০ হাজার। পরে এসব মামলায় ৯৮৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ; যাদের অধিকাংশই এখন জামিনে রয়েছেন।

হামলার ব্যাপকতা বেশি ছিল কুমিল্লা, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলায়। পুলিশের তথ্য বলছে, এ তিন জেলায় ৫৬টি মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন চার শতাধিক আসামি। পরে জামিনে বেরিয়ে গেছেন অধিকাংশই।

ঘটনায় সূত্রপাত হওয়া কুমিল্লায় মোট ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১০৭ জন। এদেরও অধিকাংশ জামিনে মুক্ত। তবে মূল অভিযুক্ত ইকবাল এখনও কারাগারে রয়েছেন।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান জানান, মামলাগুলোর মধ্যে জেলা পুলিশ তদন্ত করছে দুটি, যা শেষ পর্যায়ে। শিগগির তারা প্রতিবেদন আদালতে জমা দেবেন।

সেখানকার সাতটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। চারটির তদন্তভার পাওয়া পিবিআই একটির অভিযোগপত্র দিয়েছে।

জেলা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, তারা পাঁচটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছেন। এগুলোতে ১০৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

আরেকটি মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “মামলাটি ঘটনার সময় সঠিক ধারায় থানায় রেকর্ড হয়নি। এজন্য আমরা আদালত ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা ২-এর কাছে মামলার ধারা পরিবর্তনের আবেদন করেছি। সেখান থেকে আদেশের কপি পেলেই আমরা অভিযোগপত্র দাখিল করব।”

সাম্প্রদায়িক সেই হামলার উত্তাপ বেশি ছড়িয়েছিল চাঁদপুরে। সেখানে সহিসংতা ও প্রাণহানীর ঘটনায় দায়ের হওয়া ১১টি মামলার মধ্যে পাঁচটির তদন্ত করছে জেলা পুলিশ।

পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ জানান, পাঁচটি মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছেন।

ওই জেলার তিনটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি আর তিনটির তদন্তভার ছিল পিবিআইর ওপর। এর মধ্যে পিবিআই একটি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে।

সাম্প্রদায়িক সেই সংঘাতে ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় নোয়াখালীতে মামলা হয় ৩২টি।

এর মধ্যে জেলা পুলিশ ১০টি মামলার তদন্ত করছে উল্লেখ করে এসপি শহীদুল ইসলাম জানান, তারা এর মধ্যেই নয়টির তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। বাকি মামলার তদন্তও শেষ পর্যায়ে।

এ জেলার বাকি মামলাগুলোর মধ্যে ১১টি সিআইডি ও ১১টি পিবিআই তদন্ত করছে। এর মধ্যে পিবিআই নয়টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে।

জেলায় জেলায় সেই সংঘাতের ঘটনার মধ্যে আট জেলায় (কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদুপর, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও বাগেরহাটে) দায়ের হওয়া ২৬টি মামলা তদন্ত করছে পিবিআই।

এ ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার জানান, এর মধ্যে ১৪টির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। একটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে।

কুমিল্লার মণ্ডপে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ

কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু এবার সেই নানুয়ার দিঘির পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। মনে ভয় আর শঙ্কাকে দূরে ঠেলে এবারও তারা সবাইকে নিয়ে উৎসবে মাতবেন বলে আশার কথা বলছেন তিনি।

জেলা প্রশাসন আর পুলিশকে পাশে থাকায় জেলার সনাতন নেতারা প্রস্তুতি র আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি।

এবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকা ও জেলার ১৭টি উপজেলায় ৭৯৪টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। প্রতিটি মণ্ডপে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে আগ থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এরই মধ্যে কয়েক দফা সকল ধর্মের মানুষদের নিয়ে প্রস্তুতিমূলক সভাও করা হয়েছে।

এ বছরে কুমিল্লার পূজা মন্ডপগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “আমরা সকল ধর্মের মানুষজন নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশেই শেষ হবে শারদীয় উৎসব।”

গতবার কুমিল্লার মত হামলা ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের প্রধান পূজামণ্ডপ জে এম সেন হলে। সেই ঘটনার মামলায় বেশির ভাগ আসামি জামিন থাকায় শঙ্কার কথা জানালেও এবার সরকারের সহযোগিতায় পূজা শান্তি-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে হবে বলে আশা প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বল।

আরও পড়ুন

Also Read: পূজায় ৩ স্তরের নিরাপত্তা: পুলিশ সদর দপ্তর

Also Read: পূজায় দুই ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখছেন ডিএমপি কমিশনার

Also Read: পূজামণ্ডপ নিয়ে কোনো হুমকি নেই: সিএমপি কমিশনার

Also Read: দুর্গাপূজা এবার ৩২ হাজার মণ্ডপে

Also Read: ক্ষত ঢেকে নানুয়ার দিঘির পাড়ে ফিরেছে ‘উৎসবের আমেজ’

Also Read: কুমিল্লা: মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা অচেনা, বলছেন স্থানীয়রা