দুর্গাপূজা: আনন্দের উৎসবে ভয়ের মেঘ সরবে কবে?

আনন্দের উৎসব দুর্গাপূজার সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলা বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে ভয়ও জাগিয়ে তোলে।

মেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2022, 08:05 PM
Updated : 24 Sept 2022, 08:05 PM

নানুয়ার দীঘির পাড়ে এবারও চলছে পূজামণ্ডপ স্থাপনের প্রস্তুতি; ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু।

প্রস্তুতি তো চলছে, তবে গত বছরের বিরূপ অভিজ্ঞতায় শঙ্কার মেঘ যে কাটেনি, তা ফুটে উঠল টিটুর কথায়- “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের আশ্বাস পাচ্ছি, নিরাপদে উৎসব পালন করতে পারব বলে। তবে আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজন এখনও আতঙ্কিত। পুরনো সেই ক্ষত এখনও শুকোয়নি।”

অসাম্প্রদায়িকতার নীতি ধরে যে বাংলাদেশের সৃষ্টি, তাতে নতুন করে কলঙ্কের ছাপ পড়েছিল ২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গাপূজার মধ্যে সাম্প্রদায়িক হামলার মধ্য দিয়ে।

গত বছরের ১৩ অক্টোবর ভোরে নানুয়ার দিঘির পাড়ে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে কুরআন পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই নগরীর চারটি মন্দির ও সাতটি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটে; আক্রান্ত হয় হিন্দুদের বাড়ি-ঘর।

ঘটনা শুধু কুমিল্লায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনী, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, মুন্সীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বরিশালে মন্দির- মণ্ডপে হামলা হয়, ভাংচুর করা হয়, আগুন দেওয়া হয় হিন্দুদের বাড়ি ও দোকানপাটে।

এক বছর বাদে আবার যখন বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবের ঢাক বাজতে যাচ্ছে, তখন নানা অভয়বাণীর মধ্যেও আনন্দ ছাপিয়ে ভয়ই বড় হয়ে উঠছে দেশের হিন্দুদের মধ্যে। আর তাতে ভিত্তি দিচ্ছে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা।

এবার পূজার প্রস্তুতির মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দুর্গা মন্দিরের নির্মাণাধীন প্রতিমা ভাংচুর করে দুর্বৃত্তরা।

তার আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলা শহরে সার্বজনীন পূজা মন্দিরে ভাংচুর হয় প্রতিমাগুলো। তারও আগে গত ২৭ অগাস্ট মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে ঘটে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা।

প্রতিবারই পূজার আগে এমন ঘটনার নজির দেখিয়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবছর দুর্গাপূজা এলেই এক শ্রেণির অপশক্তি মনে করে, প্রতিমা ভাংচুর করা তাদের অধিকার এবং এভাবে তারা পুণ্য করতে পারবে। মূর্তি ভাংচুর, মন্দিরে হামলা এখন একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, অথচ এদেশকে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবেই জানি।”

একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে মুসলমানদের যখন তাদের ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের সময় কোনো শঙ্কায় পড়তে হয় না, তখন হিন্দুদের কেন ভয়ে থাকতে হয়, সেই প্রশ্ন আসছে বারবার।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো প্রতিনিয়তই একটা শঙ্কার মধ্যে থেকেই পূজা করছি, এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এর মধ্যেও আমাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছি। 

“এবারের দুর্গাপূজার এখনও কয়েকদিন বাকি, এর মধ্যেই প্রতিমা ভাংচুরের খবর শোনা যাচ্ছে। প্রশাসন থেকে প্রতি বছরই নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়, কিন্তু এই ভাংচুর-হামলার ঘটনা তো থেমে থাকেনি।”

পূজার আগে পুলিশসহ প্রশাসনের তৎপর থাকার কথা বরাবরই আসছে দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে। এবারও নিরাপত্তার ঘাটতি না থাকাই বলা হচ্ছে।

‘দুর্গাপূজায় মূর্তি ভাঙচুর একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে’- এমন বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করছেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান।

এ ধরনের ভাংচুর কিংবা হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ উল্লেখ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সবসময়ই সব ধরনের সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি। আমাদের পুরো বাহিনী নিরাপত্তা বিষয়ে সক্রিয় থাকে।

“তারপরও কিছু কুচক্রী মহল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। আবার আমরাই কিন্তু এই অবস্থাগুলো সামাল দেই। হামলাকারীকে ধরা হয়, মামলা নেওয়া হয়। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে অনেক মামলাই আদালতে বিচারাধীন আছে।”

ঘটনাগুলোকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ‘বিচ্ছিন্ন’ বললেও তার সঙ্গে আবার একমত নন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা।

পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার, প্রশাসন এই ঘটনাগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেয়। এগুলো কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে আবারও ‘পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র’ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এই ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়।”

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যে দেখা যায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ও উপাসনালয়ে হামলা এবং প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ধারাবাহিকভাবেই ঘটছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। তার মধ্যে ২০১৯ সালে ৭২টি ঘটনায় আহত হন ১০১ জন, ২০২০ সালে ৬৭টি ঘটনায় আহত হন ৭১ জন, ২০২১ সালে ২০৪টি ঘটনায় ৩০১ জন আহত হন এবং ৩ জন নিহত হন। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ৪টি মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর, ৩টি মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং ৩টি মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুরের তথ্য দিচ্ছে আসক।

বার বার কেন একই ঘটনা?

বাংলাদেশকে ‘হিন্দুশূন্য’ করার লক্ষ্য নিয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠী এধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের নাগরিকদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য এবং দেশকে হিন্দুশূন্য করার জন্যই একদল মৌলবাদী এসব কাজ করছে।”

সাম্প্রদায়িকতাকে শক্ত হাতে দমনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। প্রতিমা ভাঙচুর এবং মন্দিরে হামলা প্রতিরোধে পুলিশ পাহারা জোরদারের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আবার ভিন্ন একটি মত জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু যে ১ হাজার ৩১৪ দিন বাংলাদেশ পরিচালনা করেছিলেন, ততদিন তিনি শক্ত হাতে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও তিনি বলেছেন- ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি। আমার কাছে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের কোন পার্থক্য নেই’।

“বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে যেতে হলে তার আদর্শকে ধারণ করতে হবে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণ করা থাকলে অনিবার্যভাবে সেই রাষ্ট্রটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, ইতিহাস এটাই বলে।”

Also Read: ‘পুলিশ প্রহরায়’ পূজা সম্প্রীতির নজির নয়: রানা দাশগুপ্ত

বর্তমানের আওয়ামী লীগের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, “ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনাগুলোই এরই প্রমাণ। এই ঘটনার কোনোটিতেই সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি এবং বিচারও হয়নি।”

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর সংঘবদ্ধ হামলার প্রেক্ষাপটে গত এক যুগ ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার মধ্যেও হামলার ঘটনায় ক্ষোভ রয়েছে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এক সমাবেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও অভিযোগের তীরবিদ্ধ করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “যারা সরকারের ভেতরে আছে, বাইরে আছে, যুগপৎভাবে এই হামলাগুলো তারা পরিচালনা করছে। আপনারা লক্ষ্য করবেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনায় ২৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের হল। 

“সেখানে মন্ত্রীর ভাইপো আছে, আওয়ামী লীগের নেতা আছে, বিএনপির নেতা আছে। আমরা বলতে চাই, একসঙ্গে যোগসাজসভাবে এই কর্মকাণ্ডগুলো আজও অব্যাহত রাখা হয়েছে।”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন মনে করেন, বিচার না হওয়ার বিষয়টি পরবর্তী হামলার ঘটনাকে উৎসাহিত করছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয়সহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন ও নিপীড়ন চলছে। এর কোনোটিরই প্রতিকার বা বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। স্বচ্ছতা বা জবাবদিহি নিশ্চিত না হওয়ায় এসব হামলা থামানো যাচ্ছে না।”

Also Read: কুমিল্লায় পুলিশ সময়মতো আসেনি, অভিযোগ মন্দির কমিটির

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথের দাবি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতার ঘটনায় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ‘নির্লিপ্ত এবং নিষ্ক্রিয়’ থাকে।

“সুশাসনের বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে প্রশাসনিকভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলোকে সেভাবে চিহ্নিত করাও হয় না। আমরা আগের চেয়ে ভালো আছি, এইটা প্রমাণের জন্যই হয়ত এসব ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়।”

এই অবস্থার অবসান চাইছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার, চাইছেন নিরুপদ্রবে নিজ দেশে থাকার নিশ্চয়তা।

“অন্যান্য অনেক দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করে বলা হয়, অমুক দেশের চেয়ে তো এখানে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা কম হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা একটা আত্মতুষ্টির জায়গায় চলে গিয়েছি। কিন্তু অন্যায় তো অন্যায়ই। আমরা চাই, ধর্মীয় কারণে কেউ যেন নিগৃহীত না হয়।”

  • প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি আবদুর রহমান