এর আগের বাঘ শুমারি বা গণনার তথ্য ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসের দিন প্রকাশ করা হত। এবার সেই কাজ শেষ না হওয়ায় তা পিছিয়ে গেছে।
Published : 29 Jul 2024, 10:07 AM
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা জানতে জরিপের কাজ প্রায় শেষ দিকে; চলছে যাচাই বাছাই আর বিশ্লেষণ। তাতে পায়ের ছাপে অনেক বাঘের বাচ্চার ছাপ মিলেছে, সেটি দেখে ধারণা করা হচ্ছে বাঘ বেড়েছে বিচিত্র প্রাণ সম্ভারের এ বনে।
বিশাল আয়তনের এ বনে বাঘের খাবারের ব্যাপ্তিও দ্বিগুণ হয়েছে, যা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনার বেলায় আশা জাগাচ্ছে কর্মকর্তাদের মনে।
সবশেষ ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪।
বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তিন বছর মেয়াদি ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ’ প্রকল্পের আওতায় বাঘের সংখ্যা নিরুপণ, বাঘের খাদ্য, নিরাপদ আবাসস্থল জানার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় শুমারির কাজও করা হয়।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ২০২১ ও ২০২২ সাল ধরে চলা শুমারি জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হবে আগামী সেপ্টেম্বরে। তখনই জানা যাবে বাঘের সংখ্যার হেরফেরের তথ্য।
তবে বিভিন্ন উদ্যোগের ইতিবাচক ফল হিসেবে বাঘের সংখ্যা বাড়বে বলে আশাবাদী তিনি।
এর আগের বাঘ শুমারি বা গণনার তথ্য ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসের দিন প্রকাশ করা হত। এবার সেই কাজ শেষ না হওয়ায় তা পিছিয়ে গেছে বলে বন কর্মকর্তারা জানান।
এবার বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হবে সোমবার। এ দিবস উদযাপন করা হয় দেশে-বিদেশে।
বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শুমারিতে বাঘ গণনায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছে ২০১৫ সালের তুলনায় অন্তত ১৫ শতাংশ বেশি। এর কারণ হিসাবে তারা বলছেন, হতে পারে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, না হয় বাঘের চলাচল বেড়েছে। তবে পায়ের ছাপে অনেক বাঘের বাচ্চার ছাপ মিলেছে, সেটি দেখে ধারণা করা হচ্ছে সংখ্যা বাড়ার।
আইন করে সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়ায় আগের চেয়ে কিছুটা হলেও কমেছে বাঘ শিকার ও চোরাচালান। এর সঙ্গে আরও কিছু উদ্যোগের ইতিবাচক ফল দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন ঘিরে নেওয়া এসব উদ্যেগ দেশের অন্য সব বনেও শুরু করলে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়তে। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, ৬০ থেকে ৭০ বছর আগে দেশের প্রায় সব বনেই বাঘের দেখা মিলত।
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার অংশ বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় পড়েছে; বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায়।
এ বিচিত্র প্রাণ সম্ভারের বড় স্বাতন্ত্র্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একক জায়গা হিসেবে সুন্দরবনেই এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাঘ ছিল। তবে বন উজাড় ও অবৈধ শিকারের ফলে ‘বিপদাপন্ন’ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে প্রাণীটি।
বিশ্বে বুনো পরিবেশে টিকে থাকা বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৮৯০। এর মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে সুন্দরবনের দুই অংশ মিলিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে দুইশর কিছু বেশি।
২০০৪ সালে বন বিভাগের জরিপে পায়ের ‘ছাপ’ গণনা করে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। ২০১৫ সালে প্রথম ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করে বাঘের ছবি তুলে এবং পায়ের ছাপ গণনা করে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে বাঘের ওপর জরিপ চালানো হয়। ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে করা শুমারিতে এ সংখ্যা নেমে আসে ১০৬। ২০১৮ সালের তা বেড়ে ১১৪ হয়। এরপর থেকে নতুন শুমারি হয়নি।
বাঘ বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাঘের অবস্থা সুন্দরবনে ভালোই বলতে হবে। এক সময় কমে যাবার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছিল সেটা কমে এসেছে। ধীরগতিতে হলেও বাঘের সংখ্যা বাড়ার চিত্রই পাওয়া যাচ্ছে।
তার ভাষ্য, বন বিভাগও সর্বোচ্চ জনশক্তি, লজিস্টিক সুন্দরবনেই নিযুক্ত করেছে। একমাত্র সুন্দরবনেই স্মার্ট পেট্রোলিং চালু আছে, যা অন্যান্য বনে এখনও চালু হয়নি, যা আগের তুলনায় অনেক আধুনিক। এ কারণেই বন সংক্রান্ত অপরাধ বিশেষত চোরাশিকার অনেকটাই কমে এসেছে।
ডাকাতের উপদ্রব কমার পাশাপাশি চোরাশিকার বা অপহরণের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা কমেছে মন্তব্য করে মনিরুল এইচ খান বলেন, সার্বিকভাবে বলতে হবে সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে এই অবস্থা ভালোর দিকে।
“কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের সব বনেই আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে বাঘ ছিল। সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম, মধুপুর বনে এমনকি উত্তরবঙ্গেও যে শালবন আছে সেসব জায়গার বনাঞ্চলেও একসময় বাঘের দেখা মিলত। বৃহৎ ও গভীর বনাঞ্চল হওয়ায় ওইসব এলাকায় তখন কয়েক প্রজাতির হরিণ বুনো-মহিশ শুকোর জাতীয় প্রাণীর আনাগোনা ছিল, ফলে সেসময় ওইসব এলাকাতে বাঘও ছিল।
”এখন পার্বত্য চট্রগ্রামে হয়তো খুব কম সংখ্যক বাঘ আছে, কিন্তু দেশের অন্য কোনো বনে আর বাঘ নেই। অন্যান্য এলাকার ল্যান্ডস্কেপের দিকে তাকালে তাহলে বাঘের জন্য অবস্থা খুব খারাপ, তবে সুন্দরবনের অবস্থা তুলনামূলক ভালো।”
বাঘ রক্ষার জন্য করণীয় আরও অনেক কিছু করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যেমন বাঘ সংরক্ষণের জন্য টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানের দ্বিতীয় পর্যায় এখন চালু আছে। সেই প্লানে প্রতি দুই বছরে একবার করে বাঘের সংখ্যা মনিটরিং বা ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে মনিটরিং করার বিষয় আছে। কিন্তু এই মনিটরিং করা হয় পাঁচ থেকে ছয় বছর পর পর।
”এত বছরের গ্যাপ পড়লে মাঝখানে অনেক কিছুই হওয়া সম্ভব, হয়তো আমরা জানতেও পারব না। মনিটরিং না হলে ট্রেন্ডটা কোনদিকে যাচ্ছে বলা সম্ভব না। এছাড়া পার্বত্য চট্রগ্রামে সার্ভে করে বাঘের কি অবস্থা সেটি জানার বিষয় আছে। সেখানে বাঘকে কলোনাইজ করা যায় কি না সেই সম্ভাব্যতার বিষয় আছে কিন্তু সেসব কোনো গতি পায়নি।”
অধ্যাপক মনিরুল বলেন, ”সুন্দরবনকেন্দ্রীক যে কার্যক্রম সেটি ভালোর দিকেই আছে বলা যায়। গত দুই বারের বাঘ গননায় বাঘ বাড়ার চিত্র পাওয়া গেছিল, এবারও যেসব খবর মিলছে তাতে বলা যায় বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধির সেই চিত্রই থাকবে।”
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, বনে শিকারী প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। সর্বশেষ গণনার পর কোভিডের কারণে সুন্দরবন ভ্রমণ সম্পদ আহরণ বন্ধ ছিল বেশ বড় সময় ধরে। স্বাভাবিকভাবেই বনাঞ্চল নির্বিঘ্ন থাকলে লোকসমাগম কম থাকলে জীববৈচিত্রর উন্নয়ণ ঘটে। এটি সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকেই ধরে নেওয়া যায়।
তিনি বলেন, কোভিডের পর আবার যখন সুন্দরবনে ভ্রমণ শুরু হয় তখন যারা সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েছেন, তাদের অনেকেই বাঘের বাচ্চাসহ বাঘ দেখতে পেয়েছেন। এসব থেকে দেখে ধরে নেওয়া যায় সেসময় বাঘের প্রজননও বেশি হয়েছে।
২০২২ সাল থেকে জুন-অগাস্ট সময়ে ভ্রমণ ও সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণার ফলও পাওয়া যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই সময় বর্ষাকাল হওয়ায় সুন্দবনের গাছের লতাপাতার পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়। এসব লতা গুল্মের উপর হরিণ নির্ভরশীল। আবার হরিণের উপর নির্ভরশীল বাঘ। সুতরাং এই তিন মাস বন্ধ থাকলে হরিণের ব্রিডিং ভালো হবে। তারা খাবার ভালো পাবে। তাহলে হয়তো বাঘের খাবারের নিশ্চয়তা সু্ন্দরবনে নিশ্চিত হয়।”
বাঘ রক্ষায় এসব কার্যক্রমের কথা তুলে প্রধান বন সংরক্ষক বলেন, “যেহেতু এসব কার্যক্রম আমরা চালিয়েছি এবং গত দশ বছর ধরে কমিউনিটির সঙ্গে নিয়ে পেট্রোলিং করি। ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম করেছি।
”একসময় লোকালয়ে বাঘ চলে এলে সেসব বাঘ পিটিয়ে মেরে ফেলা হত কিন্তু শেষ আট দশ বছরে এরকম ঘটনা অনেক কমে এসেছে। আমাদের নজরে এরকম একটি ঘটনায় এসেছে, সেটিও ২০১৮ সালে। তারপর এরকম ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি। এই কাজগুলো আমরা নিয়মিত বাস্তবায়ন করেছি।”
এগুলোর ইতিবাচক ফল বাঘ শুমারিতে দেখা যাবে বলে আশা তার।
পুরনো খবর-
লোকালয়ে বাঘের আনাগোনার পেছনে খাবার সঙ্কট?
বিকল্প পেশা চান সুন্দরবনের বনজীবীরা
বাঘ: চোরাশিকার ও পাচার কতটুকু কমেছে?
সুন্দরবনে বাঘ বেড়ে এখন ১১৪টি: বন বিভাগ