সন্ধ্যা নামতেই মেলায় বাড়তে থাকে সমাগম। আড্ডা-গল্পে আর বই কেনায় প্রথমদিনই জমে উঠতে দেখা যায় বইমেলা।
Published : 01 Feb 2025, 11:13 PM
ভাষার মাসের প্রথম দিনেই পর্দা উঠল বইপ্রেমী মানুষের প্রাণের মেলার। অমর একুশে বইমেলা শুরুর মধ্য দিয়ে লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের দীর্ঘ এক বছরের অপেক্ষা ঘুচল।
উদ্বোধনের প্রথম দিন মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেল বইপ্রেমি মানুষের ভিড়। একই সঙ্গে চোখে পড়েছে নানা অব্যবস্থাপনা ও ভোগান্তি।
শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার পর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় মেলার প্রবেশ্বদ্বার।
এরপর সন্ধ্যা নামতেই বাড়তে থাকে সমাগম। আড্ডা-গল্পে আর বই কেনায় প্রথমদিনই জমে উঠতে দেখা যায় বইমেলা।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৫’ উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও বিতরণ করেন তিনি।
এবার পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন কবিতায় মাসুদ খান, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ বা গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, অনুবাদে জি এইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ।
অধিকাংশ প্রকাশক মেলার প্রথম দিন থেকেই স্টল চালু করতে পারলেও কিছু কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলের পাশ থেকে শোনা যায় ঠুক ঠুক শব্দ। আর মেলার মাঠে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে নির্মাণ বিভিন্ন রকম সামগ্রী।
মেলায় আসা দর্শণার্থীদের কেউ কেউ প্রথম দিন বইও কেনেন। তানভীর নামের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে পছন্দের বই কিনেছেন তিনি।
মেলার নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটাও হতাশাও প্রকাশ করলেন এই বইপ্রেমী।
তিনি বলেন, “মেলার প্রবেশদ্বারে দেখলাম পুলিশ সদস্যরা বসে বসে ঝিমুচ্ছেন, লোক ধাক্কাধাক্কি করে প্রবেশ করছেন। মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাজুক।”
তবে বইমেলা পরিচালনা কমিটি বলছে, তারা মেলার প্রথম দিন থেকেই গোছানো একটা পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছেন। দু-একটা প্রকাশনা ছাড়া প্রায় সব স্টলই প্রথম দিন থেকেই চালু হয়েছে।
কমিটির সদস্য-সচিব সরকার আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশিরভাগ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই প্রথম দিনই স্টল চালু করেছেন। হাতেগোনা কয়েকটি স্টলের কাজ চলছে, আশা করি তারাও পুরোদমে দ্বিতীয় দিনই স্টল চালু করবেন।”
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. রেজাউল করিম বাদশা বলেন, “বই জাতীয় চেতনার প্রতীক। জাতির মননের যথার্থ বিকাশের জন্য প্রকাশনাকে শিল্প ঘোষণা করা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রকাশক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করাও সময়ের দাবি।”
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’।
সেইসঙ্গে মেলার রঙ, প্রতিপাদ্য আর দৃশ্যপটেও এসেছে নানান পরিবর্তন। এবার গণআন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে আছে ‘জুলাই চত্বর’।
বইমেলা সেজেছে লাল-কালো আর সাদা রঙে; ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিপ্লব, শোক আর আশার প্রদীপ।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ বছরের বইমেলাও এ চেতনার আলোকে আবর্তিত হবে বলে আশা করা যায়।
“একশ বছর আগে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্যোগে যে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ সংঘটিত হয়েছিল তার উত্তরসাধক হিসেবে আজকের তরুণ লেখকদের চিন্তার বদ্ধতা অতিক্রম করে উন্নত মন ও মননের সাধনা করতে হবে।”
এবার নাটক ও নাট্যসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন শুভাশিস সিনহা। মৌলভীবাজারের ঘোড়ামারা গ্রাম থেকে বইমেলায় এসেছেন তিনি। পুরস্কার গ্রহণের পর মেলার মাঠে পাওয়া গেলো তাকে।
শুভাশিস সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবারই তো বইমেলায় আসা হয়, তবে এবার মেলার প্রথম দিন আসা হলো পুরস্কার গ্রহণের জন্য। মেলায় ঘুরছি, ভালো লাগছে।
“বইমেলাকে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় বৃদ্ধি করার চেয়েও বেশি জরুরি মানসম্পন্ন বইকে ছড়িয়ে দেওয়া। নানা মত ও পথের বইয়ের মধ্যদিয়ে বৈচিত্র্যময় মিলনমেলা যেন হয়।”
শুভাশিস সিনহার সঙ্গে ছিলেন মঞ্চ অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা, সংগীতশিল্পী শর্মিলা সিনহা এবং চিত্রশিল্পী শাহনাজ জাহান।
শর্মিলা সিনহা বলেন, “বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হওয়ার পর এবারই প্রথম মেলায় এসেছি। মেলার পরিসর যে এত বড় হয়েছে, তা দেখে ভালো লাগছে। তবে গুণগত মানের বিষয়টিও মেলা কমিটিকে ভাবা উচিত।”
এবার বইমেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে শতাধিক, একই সঙ্গে বেড়েছে আয়তনও।
মেলায় ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৮৪ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গেল বার ৬৪২ প্রতিষ্ঠান এবং ৯৪৬ ইউনিট নিয়ে হয়েছিল বইমেলা।
এ বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে ৩৬টি। গত বছরও প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি ছিল।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায় করা হয়েছে। সেখানে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩০টি লিটলম্যাগকে।
এ ছাড়া শিশু চত্বরে ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া দিয়ে কর্তৃপক্ষ। গত বছর শিশু চত্বরে ৬৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৯ ইউনিট দেওয়া হয়েছিল।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, “জুলাই গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয়েছে। আমরা একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণমানুষের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক বইমেলা আয়োজনের চেষ্টা করেছি।”
মেলার নতুন বই
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রথম দিন নতুন বইয়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মেলার মাঠে ঘুরে দেখা গেছে অনেক স্টলেই সাজানো আছে নতুন বই।
প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য জানিয়েছে, তারা এবার ৫২টি বিষয়ের উপর ২ শতাধিক বই প্রকাশ করছে, যার মধ্যে ২৫ জন নতুন লেখকের প্রথম বই রয়েছে।
প্রকাশনা ও বই বিপণন কেন্দ্র বাতিঘর এবার ৬০টির মতো নতুন বই আনবে, যার মধ্যে ৩০টির বেশি বই মেলায় এসেছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
মাজহার সরকারের কবিতার বই ‘ঝিটকি ফুলের ক্ষমতা’ এনেছে জাগৃতি প্রকাশনী। অনন্যা প্রকাশনী এনেছে আবদুল হাই শিকদারের ‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’।
কথাপ্রকাশ এনেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘উন্নতি উত্থান অভ্যুত্থান’, মশিউল আলমের অনুবাদে মাওলা ব্রাদার্স এনেছে ‘বিষয় দস্তইয়েফস্কি’, অন্যপ্রকাশ এনেছে এম আব্দুল আলীমের ‘ভাষা আন্দোলনে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’।
মেলার সূচি
প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার ও সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ৮ ফেব্রুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত থাকবে ‘শিশুপ্রহর’।
অমর একুশ উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতা থাকছে। উদ্যানে থাকবে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।
১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যাবে না।
ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
মেলার কোথায় কী
বাংলা একাডেমী বলছে, এবার সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতই রাখা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে মেলার বের হওয়ার পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির গেইটের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে।
টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্ল্যান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট চারটি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ রয়েছে।
খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সীমানা ঘেঁষে রাখা হয়েছে। নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবাও রয়েছে মেলায়।
মন্দির গেইটের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে শিশু চত্বর, যাতে অবাধে চলতে-ফিরতে পারবে শিশুরা।
বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বই বিক্রি করছে ২৫ শতাংশ কমিশনে। বাংলা একাডেমির তিনটি প্যাভিলিয়ন ও শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার জন্য রয়েছে একটি স্টল।
এবারের বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ৪৩টি ও পুনর্মুদ্রিত ৪১টি বই।
বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে রাখা হয়েছে আর্চওয়ের ব্যবস্থা। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকছে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
রোববার যা থাকছে
রোববার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হবে কবি হেলাল হাফিজ স্মরণে আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন কুদরত-ই-হুদা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মৃদুল মাহবুব ও সাইয়েদ জামিল। সভাপতিত্ব করবেন সুমন রহমান।
রোববার মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং শেষ হবে রাত ৯টায়।
আরও পড়ুন-
এবার বইমেলায় বেড়েছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান
মেলায় প্রকাশের আগে বইয়ের পাণ্ডুলিপি যাচাই চায় পুলিশ