‘এত কিছুর পরও’ সাকিবদের জন্য ‘গর্বে বুক ভরে যায়’ আরাভের

“অনেকেই অনেক ধরনের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও এত কিছু শোনার পরেও সাকিব আল হাসান ভাই এসেছেন, তাকে ধন্যবাদ। সে কিন্তু পিছু হাঁটেনি, কেউই হটেনি।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2023, 05:26 PM
Updated : 16 March 2023, 05:26 PM

অনেক ‘নেতিবাচক কথা’ শোনার পরও দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যাওয়ায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন হঠাৎ আলোচিত হয়ে ওঠা আরাভ খান; যাকে এক খুনের মামলায় খোঁজার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ বলছে, এই আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম; যিনি ঢাকায় পুলিশ হত্যা মামলার আসামি।

সাকিব ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস, অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদীন দীঘি, ইউটিউবার হিরো আলম।

তাদের এ দুবাই যাত্রা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, আরাভ যে খুনের মামলার আসামি এবং তার আসল নাম যে রবিউল তা সাকিব ও অন্যান্যদের জানানো হয়েছে। তারপরও তারা সেখানে গেছেন।

এমন বিতর্কের মধ্যেও দুবাইয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর আরাভ খান কৃতজ্ঞ সাকিবসহ তার অতিথিদের কছে। বৃহস্পতিবার ফেইসবুক লাইভে প্রকাশ করেছেন তার সেই মনোভাব। একই সঙ্গে হত্যাসহ যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার সবই অস্বীকার করেছেন তিনি।

গয়নার দোকানের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজক খুনের মামলার আসামি হওয়ার তথ্য পুলিশের পক্ষ থেকে জানানোর পরও এতে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাকিবের হোয়াটসঅ্যাপে বৃহস্পতিবার বিকালে ও রাতে একাধিকার কল করে ও বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফেইসবুকে দীর্ঘ লাইভে আরাভ তার ‘আসল নাম’ কী সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য না দিয়ে স্বীকার করেন, তার বাড়ি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। ঢাকায় এসে কাজ করেছেন হোটেলে।

তার দাবি, তিনি দুবাইয়ের স্বর্ণের বাজারে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা দেওয়ার পরই তার ব্যবসায়িক শত্রুরা উঠে-পড়ে লেগেছে। তারাই ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সহায়তায় বিদেশে পালিয়ে যেতে পেরেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, সেটিও নাকচ করে দিয়েছেন আরাভ।

সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস পেলে দেশে আসবেন জানিয়ে আরাভ বলছেন, “আমি কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের ভয়ে বাংলাদেশে আসি না, তা কিন্তু না, বাংলাদেশে আসি। কিন্তু আমাকে যদি আশ্বস্ত করেন ‘আপন তুমি আস, আমরা এটা সুষ্ঠু বিচার করব’, আমি অবশ্যই আসব। কোনো সমস্যা নেই।”

দুবাইয়ে গহনার দোকান উদ্বোধনের সূত্র ধরে আলোচনায় আসার পর আরাভ বা রবিউলকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে জানিয়ে বুধবার পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, “ওই রবিউল এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে, যেখানে তার নাম লেখা আরাভ খান।”

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, আরাভ বা রবিউলের বিরুদ্ধে ১২টি মামলার হদিস পেয়েছেন তারা।

যেখানে তার গ্রামের বাড়ি সেই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থানার পুলিশ বলছে, রবিউলের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, চুরি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে নয়টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

Also Read: আরাভ ‘খুনের আসামি’ জেনেই দুবাই গেছেন সাকিব: ডিবি

তার বিরুদ্ধে ডজনেরও বেশি বিয়ের অভিযোগ রয়েছে। এইসব মামলার অনেকগুলো করেছেন তারই প্রাক্তন স্ত্রীরা।

নিজ গ্রামে সোহাগ মোল্লা হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি কী করে রাতারাতি এত ধনী হলেন সেটি নিয়ে বিস্মিত স্থানীয়রা।

‘সাকিবকে ধন্যবাদ’

গয়নার দোকান উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের পর বৃহস্পতিবার নিজের ফেইসবুকে এ বিষয়ে কথা বলেন আরাভ। ২২ মিনিটের ওই লাইভে তিনি বলেন, “গণমাধ্যমে এত আলোচনার পরও তার গয়নার দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভালোভাবেই শেষ হয়েছে।

“অনেকেই অনেক ধরনের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও এত কিছু শোনার পরেও সাকিব আল হাসান ভাই এসেছেন, তাকে ধন্যবাদ। সে কিন্তু পিছু হাটেনি, কেউই হটেনি। আমার ওখানে এতগুলো আর্টিস্ট গিয়েছিল! আলহামদুলিল্লাহ, গর্বে বুক ভরে যায়।”

‘খুন আমার অফিসে, আমি জড়িত নই’

ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি প্রধান হারুন জানিয়েছেন, এই আরাভই পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম।

২০১৮ সালের ৮ জুলাই বন্ধু রহমত উল্লাহ সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন মামুন। পরদিন তার মরদেহ বস্তায় ভরে উলুখোলার জঙ্গলে নিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়।

এ ঘটনার তদন্ত করে পরের বছর এপ্রিলে রবিউলসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

রবিউলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরন ইউনিয়নে। তিনি ‘সোহাগ মোল্লা’ নামেও এলাকায় পরিচিত ছিলেন।

মামুন হত্যার পর তাকে খুঁজতে এলাকায় গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, সোহাগই ঢাকায় রবিউল, আপন, হৃদয়সহ বিভিন্ন নামে পরিচয় দিয়েছেন।

এসব অভিযোগ নিয়েও এদিন লাইভে কথা বলেন আরাভ। তিনি বলেন, “গণমাধ্যমে যেটা বলছে সেটা পুরোপুরি সত্য না। মার্ডার কেসটা সত্য, আমার অফিসে মার্ডারটা হয়েছিল। আমি ছিলাম না এটা সত্য।

Also Read: হত্যার আসামি রবিউলই দুবাইয়ের আরাভ খান, বলছে পুলিশ

“আমি খুনের সঙ্গে জড়িত না। ওই দিন আমি ছিলাম না। মামলায় আমার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে। সেটা যদি আমার অপরাধ হয়, আমি কথা বলেছি, গুমের সঙ্গে আমি জড়িত, সেই শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব।”

এ মামলার পেছনে ‘শত্রুতা’ ছিল বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, “কেসটা হচ্ছে যে, ২০১৮ সালে আমার অফিস বনানীতে ছিল। আমি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করতাম ‘আপন বিল্ডার্স’। তখনও আমার ‘শত্রু’ ছিল। আমি আমার বাসাতে ভাত খাচ্ছিলাম। আমার অফিসে একটা মার্ডার হয়েছে, আমাকে ফোন করে জানাল। আমার অ্যাসিসটেন্ট, বডিগার্ড আমাকে ফোন করে মার্ডারের কথা জানায়।

“আমি তাদের কাছে জানতে চাই কীভাবে হয়েছে, তারা বর্ণনা দেয়। যিনি মার্ডার হয়েছেন তিনি ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। এটা সম্পূর্ণ একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। ওখানে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কথা কাটাকাটি নিয়ে ঝগড়া হয়। আমার অপরাধ হচ্ছে আমি ওই অফিসের মালিক। আমি ওই কোম্পানির মালিক।”

তিনি বলেন, “আরে ভাই পাঁচ বছর আগের ঘটনা, আমি যদি খুনি হতাম তাহলে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতাম। মানুষের সামনে আসতাম না।”

Also Read: ‘অভিনয়ের সঙ্গীদের ফাঁদে’ খুন হন এসবি পরিদর্শক মামুন

এ পাঁচ বছরের একটা দিনও তিনি কখনও অফলাইন হননি দাবি করে বলেন, “যা কিছু রটে কিছু বটে। আমি বলিনি কেস নাই, কেস আছে।… আমার অমেরিকার গ্রিন কার্ড আছে, আমার কানাডার পাসপোর্ট আছে। আমি তো চলে যেতে পারতাম। সকাল বেলাও আমার এক বড় ভাই বলেছে, ‘তুমি প্যারিসে চলে আস’।

“আমার কথা হচ্ছে, দেখেন আমার মনে একটুও দুর্বলতা নেই। আমি এই খুনের সঙ্গে জড়িত না, আমি ছিলামই না। আমি যদি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতাম, আমি এখান থেকে পালিয়ে আমেরিকা চলে যেতাম, না হলে কানাডা চলে যেতাম। ভালো একটা দেশে চলে যেতাম।”

দিনমজুর বাবার সন্তান ধনী হয়েছেন ‘ভাই ব্রাদারদের’ বদৌলতে

পাসপোর্ট অনুযায়ী আরাভের জন্ম ১৯৯৩ সালে। অর্থাৎ এখন তার ৩০ বছর বয়স।

তার বাবা ভাঙারির ব্যবসা করতেন। তার সন্তান হয়ে ৩০ বছর বয়সে কীভাবে দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান দেওয়ার মতো ধনী হয়ে উঠলেন, তার ব্যাখ্যা দেননি তিনি। শুধু দাবি করেছেন, “কষ্ট করে দারিদ্র্য জয় করেছেন।“

তিনি স্বীকার করেন, তার বাবা দিনমজুর ছিলেন। তিনিও ঢাকায় এসে হোটেলে কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, “আমার বাবা অনেক কষ্ট করেছে দিনমজুরি করেছে। আমি চেষ্টা করেছি ঢাকায় এসে কিছু করার জন্য। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জের যারা আছেন যে সব জায়গাতে বড় বড় অফিসার বা আমার যারা ভাইব্রাদার তারা আমার পাশে ছিলেন সব সময়। আমাকে ভালবাসছেন।”

পুলিশের সদ্য অবসরে যাওয়া এক শীর্ষ কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় তার এই অবস্থান বলে সংবাদমাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে সেটিকেও নাকচ করেন দুবাইয়ের এ অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে নাম আসা আরাভ।

তিনি বলেন, “এও বলা হয়েছে আমাকে ডিবি উঠিয়ে নিয়ে গেছে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা হেল্প করে ফ্লাইট করে দিয়েছে- এটা মিথ্যা। যাদের নাম বলা হয়েছে তারা কোনোভাবেই জড়িত না।”

তার কাছে ঢাকার একটি সংবাদমাধ্যম পাঁচ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেছিল বলেও অভিযোগ আনেন তিনি। সেই সংবাদমাধ্যমের নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেছেন, সেই সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা তাকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন।