ইউনূসের আইনজীবী ব্যরিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সাজার রায় থেকে খালাস চেয়ে ৩০টি যুক্তি তারা আপিলে তুলে ধরেছেন।
Published : 28 Jan 2024, 10:23 AM
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন গ্রামীণ টেলিকমে চেয়ারম্যান, শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসসহ চার আসামি।
ইউনূসের আইনজীবী ব্যরিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সাজার রায় থেকে খালাস চেয়ে ৩০টি যুক্তি তারা আপিলে তুলে ধরেছেন।
ইউনূসের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহানকে এ মামলায় ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী এস এম মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আপিল আবেদনে রায় স্থগিত এবং জামিন চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে শুনানির জন্য বেলা পৌনে ১১টা কাকারাইলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে হাজির হন ইউনূসসহ দণ্ডিত চারজন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানও আদালতে উপস্থিত হয়েছেন।
ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “যে অভিযোগে ও অপরাধের দায়ে সাজা দেয়া হয়েছে তা আরজিতে সুনির্দিষ্ট ছিল না। তারপরও আমরা জেরা করে অস্পষ্ট অভিযোগ খণ্ডন করেছিলাম। আপিলে আইনগত বিষয় উল্লেখ করেছি। আশা করি শ্রম অ্যাপিলেট ট্রাইবুনালের বিচারক এম এ আউয়াল তা মঞ্জুর করবেন।”
গ্রামীণ টেলিকমের ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করা, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়ার অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূসসহ চার জনকে আসামি করেন।
গত ১ জানুয়ারি এই মামলায় চার জনকেকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা। তবে আপিলের শর্তে সেদিনই সাজাপ্রাপ্তদের এক মাসের জামিন দেওয়ায় কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি।
১১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আপিলর প্রক্রিয়া শুরু করেন ইউনূসের আইনজীবীরা।
এ মামলায় ইউনূসের সাজা হওয়ার পর দেশের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়া এসেছে বিদেশ থেকেও।
যুক্তরাষ্ট্র সেনেটের ১২ সদস্য এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ইউনূসকে ‘হয়রানি’ করা হচ্ছে অভিযোগ করে তা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে সেখানে।
সেনেটররা চিঠিতে লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে, যার মধ্যে আছে অভিন্ন স্বার্থে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা। অধ্যাপক ইউনূসকে হয়রানির অবসান এবং অন্যদের সরকারের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে বাক্স্বাধীনতা চর্চা করার সুযোগ এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করবে।”
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্বাধীন আদালত বিচার করেছে। এখানে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
মামলার বাদী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানিয়েছেন তীব্র প্রতিক্রিয়া। তিনি সেনেটরদের এই মামলার বিচার পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, “১২ সেনেটরের চিঠি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। কারণ, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন। ড. ইউনূস দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন। আইনি সুযোগ নিয়ে তিনি এখন জামিনে রয়েছেন।”
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টাকে ‘শান্তি স্থাপন’ বিবেচনা করে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে, যে প্রতিষ্ঠানটির সূচনা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে একটি সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ চেষ্টার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন নোবেল বিজয়ী ইউনূস। জরুরি অবস্থার মধ্যে বড় সব দল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখতে বাধ্য হলেও ইউনূসকে নতুন দল গঠনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল তখন, যা ছিল ইউনূসের প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ।
এরপর নরওয়ের টেলিভিশনে ২০১০ এর ডিসেম্বরে প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া বিদেশি অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগ ওঠে ইউনূসের বিরুদ্ধে। সেই প্রামাণ্যচিত্র নতুন করে সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে যায় গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসকে। ঋণ দেওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংক গ্রহীতাদের কাছ থেকে যে প্রক্রিয়ায় কিস্তি আদায় করে- তা নিয়েও শুরু হয় নতুন সমালোচনা।
দেশে ও বিদেশে বাম ধারার অনেক বুদ্ধিজীবী দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষুদ্র ঋণের বিরুদ্ধে বলে আসছেন। তাদের মতে, দারিদ্র্য বিমোচনে এই ঋণের ভূমিকা প্রমাণিত নয়। আর গ্রামবাংলায় সুদখোর মহাজনেরা সব সময়ই পরিচিত ছিলেন ‘রক্তচোষা’ হিসেবে। সেই বিবেচনা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে সময় ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “গরিব মানুষের রক্ত চুষে খেলে ধরা খেতে হয়।”
সরকারের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউনূস এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে এলেও ২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ায় তার পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বছর মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ইউনূসকে অব্যাহতি দেয়, তখন তার বয়স প্রায় ৭১।
যেখানে সরকারি চাকরিতে অবসরের সীমা তখন ছিল ৫৭ বছর, অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অবসরের বয়স ছিল ৬০, বিচারকদের ৬৭, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের ৬৫, সেই পরিস্থিতিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই অব্যাহতির আদেশকে ‘প্রতিহিংসা’ হিসেবে দেখেছিলেন অনেকে।
ইউনূস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যান এবং দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আপিল বিভাগের আদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারান।
এরপরও তাকে পদে রাখার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। ইউনূসের বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনায় পড়তে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে ইউনূসের বক্তিগত বন্ধুত্বের বিষয়টি সব মহলেরই জানা। গ্রামীণ ব্যাংকের পদ নিয়ে আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই হিলারি ক্লিনটন এ ব্যাপারে সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়ে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ঝুলে যাওয়ার পেছনেও ইউনূসের হাত রয়েছে। ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী বন্ধুদের তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লাগিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
ইউনূস সব সময়ই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
আরও পড়ুন:
১২ সেনেটরকে আদালতে এসে ইউনূসের মামলা পর্যবেক্ষণের পরামর্শ আইনজীবীর
শ্রমিক ঠকানোর দায়ে নোবেলজয়ী ইউনূসের ৬ মাসের সাজা
কিছু ভুল হতে পারে, আমরা তো ফেরেশতা নই: ইউনূস
কর্মচারী তহবিলের ‘অর্থ আত্মসাৎ’: ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ফের পেছাল