শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করার অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলায়।
Published : 09 Nov 2023, 04:36 PM
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন শেষে আদালত থেকে বেরিয়ে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিনি কোনো ‘অপরাধ করেননি’।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি তো নিজে এ প্রতিষ্ঠানের মালিক নই। আমার আদর্শ কর্মসূচিতে কোনো ত্রুটি ছিল না।
“এত বড় কাজ করতে গেলে কিছু ভুল হতে পারে। আমরা তো ফেরেশতা নই। কিন্তু ভুল হলে তা ইচ্ছাকৃত নয়।”
এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে যান ইউনূস। শ্রমভবনের লিফট কয়েক মাস ধরে অচল থাকার কারণে সিঁড়ি বেয়ে ছয় তলায় উঠতে হয় তাকে।
দুপুর ১টার দিকে শুনানি শুরু হয়। বিচারক ইউনুসকে এজলাসের চেয়ারে বসার অনুমতি দেন। শুনানি শুরু হলে তিনি দাঁড়িয়ে যান। আদালতে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনে ২৮ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য জমা দেওয়া হয়।
ইউনূস ছাড়াও এ মামলার অপর তিন আসামি হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। আদালতে তারাও নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
লিখিত বক্তব্যে আসামিরা বলেন, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকসহ ৫০টির অধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইউনূস গড়ে তুলেছেন। কোনো কোম্পানিতে তার নিজস্ব কোনো শেয়ার নেই। সুতরাং কোনো লভ্যাংশ বা লাভের টাকা কারও পকেটে ঢোকে না।
“যখনই দেশের গরিবদের একটা সামাজিক সমস্যা দেখেছেন, সেটার মাধ্যমেই একটা বিজনেস মডেল বানিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা সমস্যার জন্য বানিয়েছেন গ্রামীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য বানিয়েছেন গ্রামীণ কল্যাণ। এমন ব্যবসার ধারণা বা মডেল তৈরির জন্য যথেষ্ট সময় দেন, কিন্তু মালিকানায় কখনও নিজেকে জড়াননি। দেশে-বিদেশে কোথাও নিজের নামে কোনো জায়গা জমি গাড়ি-বাড়ি নেই তার।”
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, “বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেখান যিনি এতোগুলো ইম্প্যাক্ট তৈরি করেছেন। এতোগুলো বিদেশি ব্র্যান্ড কোম্পানিকে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বাংলাদেশে এনেছেন। এত এত মানবসম্পদ তৈরি করেছেন।”
কোম্পানি আইনসহ বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যাসহ এই মামলাটি কেন চলতে পারে না, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বক্তব্যে। সেখানে মামলার আসামিদের অব্যাহতির প্রার্থনা জানানো হয়।
সোয়া ঘণ্টার শুনানিতে এজলাসে কোনো কথা বলেননি ইউনূস। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
শ্রম আইনে এ মামলাটির যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী ১৬ নভেম্বর তারিখ রেখেছেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা ইসলাম।
বৃহস্পতিবার ইউনূসের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।
মামলাটিতে এরই মধ্যে চারজনের সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে গত ৬ নভেম্বর চতুর্থ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হয়েছে বলে জানান ইউনূসের আইনজীবী মামুন।
ইউনূসের বিরুদ্ধে এ মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
‘মেট্রোরেলের চেয়ে বেশি স্পিডে চলছে ইউনূসের মামলা’
শুনানি শেষে ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেন, ইউনূসসহ অন্যদের বিরুদ্ধে কলকারাখানা অধিদপ্তরের এ মামলার অভিযোগগুলো ‘ক্রিমিন্যাল অভিযোগ’ নয়।
“সিভিল বিষয়, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিষয়কে ক্রিমিনাল অপরাধ হিসাবে গণ্য করে আজকে একটা নিরীহ নিরপরাধ দেশপ্রেমিক… তিনি এ দেশের জন্য বহু কিছু করেছেন। আজকে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। এই মামলার কার্যক্রম চলছে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে।
“আপনারা দেখেছেন, গত ২ তারিখ থেকে আজ ৯ তারিখ পর্যন্ত এ মামলায় তিনটি তারিখ পড়েছে। এই যে বর্তমানে উপরে যে মেট্রোরেল চলছে, তার চেয়ে দশ গুণ বেশি স্পিডে চলছে আমাদের মামলা। গ্রামীণ টেলিকম হচ্ছে সবাই মেধাভিত্তিক। এখানে কোনো শ্রমিক নাই। তারপরও বলা হইছে উনি শ্রমকিদেরকে বলে স্থায়ী করেন নাই। “
বাদীপক্ষ থেকে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, “এ মামলা বাতিলের জন্য ওই যুক্তি (ক্রিমিন্যাল অভিযোগ নয়) দিয়ে তারা হাই কোর্টে, আপিল বিভাগে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তারা কোনো রেমেডি পান নাই। উচ্চ আদালতের আদেশের পর নিম্ন আদালতের কিছু করার নেই। এটা কোম্পানি আইন লঙ্ঘনের মামলা না। এটা শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা।”
শ্রম আদালতে ইউনূসের পক্ষে ব্যরিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন শুনানিতে বলেন, “মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান এবং অন্য ৩ জন বিবাদী পরিচালনা বোর্ড এর সদস্য হিসেবে নিয়েজিত
আছেন। গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনে রেজিস্ট্রিকৃত ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি ‘নট ফর প্রফিট’ কোম্পানি। যার লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়।
“এই লভ্যাংশের অর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। সে কারণে এই কোম্পানির কোনো মালিকানা বা শেয়ার হোল্ডার নেই। বিবাদীদের কেউই শেয়ার হোল্ডার নন। তাছাড়া বিবাদীরা শুধুমাত্র সম্মানজনক পদে থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সহায়তা করছেন। এটি ছাড়া কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় গঠিত গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মুনাফা প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। “
ইউনূসের আইনজীবী বলেন, গ্রামীণ টেলিকমের যেহেতু কোনো স্থায়ী কার্যক্রম নেই, সেহেতু এর মূল কাজ হচ্ছে চুক্তির মাধ্যমে পল্লীফোন কার্যক্রম এবং নকিয়া মোবাইল হ্যান্ডসেটের বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়া।
“পল্লীফোন কার্যক্রমটি গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং প্রতি ৩ (তিন) বছর অন্তর তা নবায়ন করা হয়। পল্লীফোন গ্রামীণ টেলিকমের একটি প্রকল্প যা গ্রামীণফোনের নির্দেশে চুক্তির ভিত্তিতে গ্রামীণ টেলিকমের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে। যার বিনিময়ে গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোন থেকে ১০ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার পায় এবং ৩ বছর পরপর চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে থাকে।
“অনুরূপভাবে ফিনল্যান্ডের নকিয়া মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ টেলিকম বাংলাদেশের সকল ক্রেতাদের নকিয়া হ্যান্ডসেটের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে থাকে। যার বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ৫ শতাংশ ডলার গ্রামীণ টেলিকম আয় করে থাকে। এই চুক্তির মেয়াদ ৩ বছর। চুক্তিটি প্রতি ৩ বছর পর পর নবায়ন করা হচ্ছে।”
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ওই দুই চুক্তির আওতায় গ্রামীণ টেলিকম আইন অনুযায়ী কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ওই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আওতায় সকল শ্রমিক কর্মচারী-কর্মকর্তা স্থায়ী শ্রমিকের মত সকল সুযোগ-সুবিধা যেমন-পদোন্নতি, নিয়মিত হওয়া, পে-স্কেল, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অর্জিত ছুটি, মেডিকেল ভাতা পেয়ে থাকেন।
“তবে গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান (নট ফর প্রফিট কোম্পানি) হওয়ায় কোম্পানি আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়। সেজন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও নিট মুনাফার ৫ শতাংশ (WPPF) প্রদান করার কোনো সুযোগ নেই।”
“বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থেকে ২০ বছর ধরে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীরা চাকরিতে থাকা অবস্থায় এবং রিটায়ারমেন্টে (অবসরে) যাবার পরও তারা কখনো মুনাফা দাবি করেনি। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ মহল, যারা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সামাজিক ব্যবসার অগ্রগতি
পছন্দ করে না, তাদের প্ররোচণায় বিভ্রান্ত হয়ে মুনাফার সুবিধা আদায়ের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ২০১৭ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সিভিল বিধানের অধীন ২১১ ধারায় তৃতীয় শ্রম আদালতে অনেকগুলো সিভিল বিএলএ (আই.আর) মামলা এবং সিবিএ কর্তৃক শিল্প বিরোধ
মোকদ্দমা দায়ের করে।”
আইনজীবী বলেন, “সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অযৌক্তিক ও আইন বহির্ভূত দাবি দাওয়া থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরত রাখার পরিবর্তে ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রামীণ টেলিকম সম্পর্কে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের অবতারণা করে মুনাফাসহ টেলিকমের অবৈতনিক চেয়ারম্যান প্রফেসর ইউনূসসহ চারজন পরিচালক বিবাদীর বিরুদ্ধে শ্রম আইনের ৩টি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করেন।”
তিনি দাবি করেন, “সব অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপূর্ণ। তাই অভিযোগ অস্বীকার করে বাদীর দায়ের করা মামলা ক্ষতিপূরণসহ খারিজ করার জন্য বিজ্ঞ আদালতে প্রার্থনা করছি।”