সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা লন্ডন শহরের মতো করা সম্ভব বলেও মত দিয়েছেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ।
Published : 27 May 2024, 12:27 AM
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেবল অবকাঠামো নির্মাণের উপর জোর না দিয়ে তার সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তাকেও প্রাধান্য দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ইনসাইড আউটে যোগ দিয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক এই পরিচালক বলেছেন, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার পেছনে রয়েছে ‘বাস মালিক ও রাজনীতিকদের মধ্যে অসাধু বন্ধন’। বিশৃঙ্খল থাকলেই তারা কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয়ের সুযোগ পায়। শৃঙ্খলা ফিরলেই তাদের এই আয় বন্ধ হয়ে যাবে।
সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা লন্ডনের মতো করে ফেলা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এ পর্ব।
ইংরেজি ভাষায় আধা ঘণ্টার এই আলোচনায় সড়ক নিরাপত্তার সমস্যা, সড়কের কাঠামোগত ত্রুটি, ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রসঙ্গ, ঢাকায় মেট্রোরেল এবং ট্রেনে দুর্ঘটনার বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে।
বুয়েটের এই অধ্যাপক দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ সড়ক নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করে আসছেন। দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা এআরআইও কাজ করে সরকারের সঙ্গে। ব্যস্ততার জন্য এই গবেষণা সংস্থা থেকে আপাতত দূরে থাকলেও তিনি মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড এর সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
৩৬ বছর বয়সে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা এই শিক্ষক বহু বছর ধরেই সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণাতেও জড়িত। সরকারকে তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে বহু সুপারিশ জমা দেওয়াও হয়েছে। এর কিছু বাস্তবায়ন হলেও বেশিরভাগ বাস্তবায়ন হয়নি।
আলোচনায় একটি প্রশ্ন ছিল মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রাজধানী শহরে বাস চলাচলের দুরবস্থা নিয়ে।
‘শিডিউল ও ফ্রিকোয়েন্সি ভিত্তিক’ চলার চরিত্র না থাকায় ঢাকা শহরের বাস পরিবহন ব্যবস্থাকে গণপরিবহন হিসাবেও মানতে নারাজ এই গবেষক।
ঢাকা শহরে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক বলেন, “গণপরিবহনকে একটা নগরীর মেরুদণ্ড হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা মেরুদণ্ডকে সোজা করতে পারিনি।
“কারণ হিসেবে, আমি বলব সেখানে অসাধু যোগসাজশ রয়েছে। কেননা, অতীতে আমরা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি করার চেষ্টা করেছিলাম। এই মডেল পৃথিবীর সব জায়গায় কাজ করেছে, এমনকি কলকাতা-দিল্লির মতো শহরেও। তারা ইতোমধ্যে তাদের গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিতে রূপান্তর করেছে।”
ঢাকায় সেই চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা সেটার চেষ্টা করেছি, পরীক্ষা করেছি, তবুও অসাধু যোগসাজশের কারণে এটা ব্যর্থ হয়েছে। এই অসাধু যোগসাজশের মধ্যে বাস মালিকরা, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকরা রয়েছে। তাদের চিন্তা হচ্ছে, ব্যবস্থার মধ্যে যদি বিশৃঙ্খলা থাকে, তাহলে সেটাতে তারা লাভ পায়।”
পরিবহন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার ফলে সড়কে অবৈধ-অননুমোদিত যানবাহন এবং বেশি পরিমাণে চাঁদাবাজির সুযোগ থাকার কথা তুলে এই গবেষক বলেন, “তারা কোটি কোটি টাকা পাচ্ছে, লাভবান হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু রাজধানী শহর এবং যারা এখানে প্রতিদিন যাতায়াত করে, তারা রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। তারা সেবা পাচ্ছে না।”
গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আমাদের জোরালো নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক সহায়তা ও শক্ত নীতি সহায়তা ছাড়া আপনি সেই যোগসাজশ ভাঙতে পারবেন না।
“আমরা যদি সেই অসাধু যোগসূত্র ভাঙতে পারি, তাহলে সুশৃঙ্খল বাস রুট ফ্যাঞ্চাইজির বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারব না। যেই উদ্যোগ কলকাতাসহ পৃথিবীর অন্যত্র বাস্তবায়ন হয়েছে। আপনি কলকাতার কথা বলেছেন, সেখানে এই উদ্যোগের ফলে বাসের ব্যবস্থা অনেক অগ্রগতি করেছে।”
পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হলে উন্নত বিশ্বের মতো বাস সেবা নিশ্চিত করা ব্যাপার না মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, “গত এক দশকে আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থ অবকাঠামোর পেছনে ব্যয় করেছি। আমি মনে করি, আমরা যদি কেবল পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারি, তাহলে আমাদের বাস সেবা লন্ডনের মতো দেখা যাবে।
“সুতরাং যদি আমরা অবকাঠামোর পেছনে গত দশকে যে অর্থ খরচ করেছি, সেই তুলনা করলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি কিছু নয়।”
কেন এত বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা
সড়কে মৃত্যুর প্রায় ৪০ শতাংশ এখন মোটর সাইকেল আরোহী। সড়ক নিরাপত্তায় এখন সবচেয়ে বেশি মাথা ব্যথার কারণই এই দুই চাকার বাহন।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে হাদিউজ্জামান বলেন, “এই সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোটরসাইকেল। যদি চাহিদার তুলনায় জোগান (অন্যা বাহন) কম থাকে, তাহলে আমি চলার জন্য অন্য পথ বেছে নেবেই। এ কারণে মোটরসাইকেলের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। কিন্তু আমরা পেশাদার চালক তৈরি করতে পারিনি”
মোটরসাইকেলকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি চার চাকার যানের চেয়ে ‘৩০ গুণ বেশি’ জানিয়ে তিনি বলেন, “মোটরসাইকেল চালক বা আরোহীরা ভারী যানের সঙ্গে ধাক্কা খেলে গুরুতর আহত হয় বা মারা যায়।”
যারা মোটর সাইকেল চালান, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা, অনেক ক্ষেত্রে লাইসেন্সের ধারও না ধারা, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা বা হেলমেটের বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করার বিষয়টিও উঠে আসে আলোচনায়।
এই দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বলেন, “হেলমেটের সরকার নির্ধারিত মান থাকতে হবে এবং সেটা বিক্রির সময় ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করতে হবে। যখন আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করব, সেই মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।”
সড়কের প্রকৌশলগত ত্রুটির দায় কতটা
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে হাদিউজ্জামান বলেন, “আমরা মূলত প্রকল্পের চক্রে আটকা পড়েছি। আমরা যখন অবকাঠামো নির্মাণ করি, বিশেষ করে ফ্লাইওভার, সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে, তখন আমরা প্রায়ই ভূমি ব্যবহারের বিষয়কে অবহেলা করি।
“আপনি যদি ভূমি ব্যবহারের বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে দেখা যায় বেশ ভালো সড়কও চার-পাঁচ পর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। সে কারণে আমরা সবসময় বলি, যখন আপনি কোনো সড়ক করবেন, আপনাকে এক-দু বছর অন্তর নিয়মিত নিরাপত্তা নিরীক্ষা করতে হবে।”
ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শক্ত কোনো নীতি না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আপনি দেখতে পাবেন সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা, কোনো কোনো সময় হাট-বাজার গড়ে উঠছে। এ কারণে ভালো সড়কও অল্প সময়ের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
“আপনাকে শুধু সড়ক নির্মাণ করলে হবে না, ভূমি ব্যবহারের সঙ্গে আপনাকে সমন্বয় করা দরকার। ভূমি ব্যবহারের বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মহাসড়কে অবৈধ ও অননুমোদিত যান, হালকা যান চলাচল আপনি সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।”
ভূমির ব্যবহার এবং সড়কের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নীতি থাকতে হবে মত দিয়ে হাদিউজ্জামান বলেন, “সেই নীতি ছাড়া কেবল অবকাঠামো দিয়ে ক্রমবর্ধমান প্রাণক্ষয় ঠেকানো যাবে না।”
গত এক দশকে বাংলাদেশে সড়কের অবকাঠামো নির্মাণে অনেক ব্যয় হলেও যানবাহন, চালক এবং যাত্রীদের বিষয় সেভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বলেও মনে করছেন করছেন হাদিউজ্জামান।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) কমিটিতে কাজ করা এই গবেষক বলেন, “আমাদের যানবাহন, চালক ও পথচারীরা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।… আমাদের সড়ক যখন আরও স্মার্ট হচ্ছে, তখন যানবাহন আর চালকরা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্মার্ট হচ্ছে না।”
পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা
পরিকল্পনা ও নীতিতে দুর্বলতা থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা সবসময় সড়ক অবকাঠামো নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু ওই সড়কের পাশে যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে তাদের দিকে যথাযথ দৃষ্টি আমরা দিচ্ছি না।”
“এখন বিশ্ব নিরাপদ ডিজাইনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা সবসময় পথচারীদের বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছে। কেননা, তারাই হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারী।… নিরাপত্তার জন্য আপনার সমন্বিত পদক্ষেপ লাগবে। আপনাকে অবশ্যই সড়ক ব্যবহারকারী ও সড়কের আশপাশের প্রতিবেশও দেখতে হবে।”
কেবল অবকাঠামো দিয়ে দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পৃথিবীর কোথাও সেটা হয়নি। আমরা লেনের প্রস্থ বাড়াতে পারি, সড়কের প্রস্থ বাড়াতে পারি, আমরা মহাসড়ক তৈরি করতে পারি; কিন্তু আপনাদের পুরো ইকোসিস্টেম নিয়ে ভাবতে হবে।
“চালকদের বিষয়, তাদের প্রশিক্ষণ, তারা কীভাবে লাইসেন্স পাচ্ছে আর সেই প্রক্রিয়া বিজ্ঞানসম্মত কি-না, বিআরটিএর মতো সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, যানবাহনের ফিটনেস ব্যবস্থা- এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
দুর্ঘটনা কমাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নে এআরআই থেকে সরকারকে অন্তত ১১১টি সুপারিশ দেওয়ার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “আমি বলতে পারি, তার মধ্যে মাত্র কয়েকটা বাস্তবায়ন হয়েছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা প্রধানত অবকাঠামোর প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি বেশি গুরুত্ব দেন। তবে সেটা তাদের নীতি।
“কিন্তু আপনি যদি দুর্ঘটনা কমাতে চান আপনাকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। পাশাপাশি ইকোসিস্টেম ঠিক করতে হবে। সেটা যদি স্মার্ট ও নিরাপদ না হয়, আপনি দুর্ঘটনা রোধ করতে পারবেন না।”
ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যর্থ কেন?
বিশ্বের উন্নত সব দেশে ট্যাক্সিক্যাব সেবা থাকলেও ঢাকায় কেন তা ব্যর্থ হলো?- এমন প্রশ্ন ছিল হাদিউজ্জামানের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “আমরা ট্যাক্সি বা অন্যান্য যানবাহন সবগুলোকে পৃথকভাবে বিবেচনা করি, সামগ্রিকভাবে নয়। ট্যাক্সিতো সারাদিন রাস্তা চলবে না, তাহলে তারা কোথায় থামবে? পার্কিংয়ের জায়গা বা কোথায়? চালকদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের কী হবে?”
নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে এই গবেষক বলেন, “এই যানবাহনের জীবনকালের ৯৫% শতাংশ সময় যায় পার্কিংয়ে, পাঁচ শতাংশ সময় তারা সড়কে থাকে। সুতরাং আপনার পার্কিং এরিয়া দরকার। এমনকি বাসের জন্য ‘বাস বে’, টার্মিনালের সুবিধা আমাদের নেই।
“এ ধরনের সমস্যাটার কথা আমরা আগে ভাবিনি। সে কারণে আমরা বিদেশ থেকে ট্যাক্সিক্যাব কিনে নিয়ে এসেছি, এরপর ট্যাক্সি ক্যাবের জন্য গাইডলাইন করেছি, যেটা মূলত ভাড়ার কাঠামো নিয়ে। কিন্তু পরে দেখা গেল, এটা দামাদামি ও ট্রিপভিত্তিক হয়ে গেল, মিটার মেনে চলেনি কেউ। সে কারণে টেকসই হয়নি।
“বিষয়টা হচ্ছে আমাদের গাইডলাইন আছে, আইন আছে কিন্তু প্রয়োগে রয়েছে ঘাটতি। আপনি যদি আইন আর গাইডলাইনকে ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারেন, সিস্টেম টেকসই হবে না। সে কারণে ট্যাক্সিক্যাব এখন ঢাকার রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেছে।”
রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রেও এখন চুক্তিতে যাওয়ার কথা তুলে ধরে এই গবেষক বলেন, “আমাদের বেকারত্বের বড় সমস্যা রয়েছে। তারা এটাকে পেশা হিসাবে নিচ্ছে। কিন্তু এটা পেশা হওয়ার কথা ছিল না।
“রাইড শেয়ারিং পলিসি করার সময় আমরা বিবেচনায় নেইনি যে, তারা এটাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এটা এখন পেশা এবং তারা সবসময় রাস্তায় থাকছে। যদিও এটা সেভাবে হওয়ার কথা ছিল না।”
কোনো নীতি করার গবেষণা দরকার হলেও সেটা করা হয় না বলে আক্ষেপ করে হাদিউজ্জামান বলেন, “অ্যাডহক ভিত্তিতে নীতি করি এবং সেটা ব্যর্থ হয়। এরপর আমরা আরেকটা নীতি করি।”
‘২০ হাজার টাকায় নিরাপদ হবে ব্যাটারিচালিত রিকশা’
ব্যাটরিচালিত রিকশা নিয়ে যে বিতর্ক সেই প্রসঙ্গটি নিয়েও কথা বলেন এআরআই এর সাবেক পরিচালক। তিনি এই রিকশাগুলো বন্ধ করার পক্ষপাতী নন, বরং সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করে এর ত্রুটি সারানো এবং লাইসেন্সিং ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
অদক্ষ ও নিরক্ষর মানুষদের জন্য এই রিকশাগুলো আয়ের উৎস- এই বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “একুশ শতকে এসে প্যাডেলচালিত রিকশা অমানবিক।”
ব্যাটারিচালিত অটো বা রিকশার সঙ্গে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ সরাসরি জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, এসব বাহনে কিছু কাঠামোগত ত্রুটি এবং যান্ত্রিক দুর্বলতা রয়েছে। তবে, এটাকে উন্নত করার উপায় ও সুযোগ রয়েছে।
“আমরা যদি এই বাহনের পেছনে ২০ হাজার টাকা খরচ করতে পারি, তাহলে আমরা এটাকে আরও নিরাপদ করতে পারব।”
কী কী যান্ত্রিক দুর্বলতা আছে, এই প্রশ্নে দুর্বল ব্রেকিং সিস্টেমের কথা সামনে আনেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, “যখন ব্যাটারি ও মোটর লাগানো হচ্ছে, তখন সেগুলোর অতিরিক্ত গতি উঠছে। সেই গতির সঙ্গে এর ব্রেকিং সিস্টেম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে, এই ব্রেকিং সিস্টেমকে উন্নত করা যায়।”
সমন্বিতভাবে তিনটি বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন এবং ক্রমান্বয়ে সেগুলো বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমটা হবে ‘স্পেসিফিকেশন স্ট্যান্ডার্ড’ নিয়ে। যদি কোনো নির্ধারিত মান না থাকে, সেক্ষেত্রে স্থানীয় গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপ নিজেদের মত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে রিকশা তৈরি করে। তখন সংখ্যা বাড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
এসব বাহনের রুট অনুমোদন এবং চালকের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সের বিষয়ে আরেকটি নীতিমালা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, “যখন তাদেরকে বৈধতা দেব, তখন আমরা তাদের সংখ্যা জানতে পারব। এরপর আমরা বিপরীতমুখী ব্যবস্থা (রিভার্স অর্ডার) নিয়ে জানতে পারব, কীভাবে সংখ্যাটা কমাব।”
ব্যাটারি ব্যবস্থাপনার জন্য আরেকটি গাইডলাইনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এই গবেষক বলেন, “আমরা কখন এবং কোথায় ব্যাটারিগুলোকে ধ্বংস করব। এখন তারা যে ব্যাটারি ব্যবহার করছে তার জীবনকাল ছয় মাস থেকে এক বছর। এখন ব্যাটারি পরিবেশের মধ্যে সরাসরি ফেলে দেওয়া হচ্ছে, এটা ঝুঁকির।”
বিদ্যুৎ চুরির যে বিষয়টি সামনে আনা হয়, তার জবাবে হাদিউজ্জামান রিকশাগুলোতে সোলার প্যানেল বসানোর ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।
“আমরা যদি কিছুটা সৃজনশীল হই, ব্যাটারি চার্জের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়বে না।…সোলার সিস্টেমে গেলে রিকশাচালকরা এখন যে পরিমাণ পথ চালাচ্ছে, তার দ্বিগুণ চালাতে পারবে। তাদেরকে বিদ্যুৎ বিলও দিতে হবে না, ফলে তারা বেশি আয় করতে পারবে।”
সোলার প্যানেল ছাদ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে এবং সেটি আরও বেশি আরামদায়ক হবে বলেও মত দেন তিনি।
দুর্বলতা আছে মেট্রোরেলেও
ঢাকা শহরের মানুষের কাছে মেট্রোরেলই প্রথম সত্যিকারের গণপরিবহন বলে মনে করছেন হাদিউজ্জামান। তবে তার বিবেচনায় এখানে ভাড়া বেশি, অবকাঠামোগত কিছু ত্রুটিও রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “ফুটপাত সংযোগ ও সুশৃঙ্খল বাস না থাকার মধ্যে মেট্রোরেল সার্ভিস চালু হয়েছে। আমার মত হচ্ছে, মেট্রো অবশ্যই নগরবাসীর বেশ উপকার করছে। তারা দ্রুত যাতায়াত করতে পারছে, ভাড়ার বিষয়ে বলব এটা ‘মাঝামাঝি অবস্থায়’। যদিও কিছু অভিযোগ আছে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ভাড়া বেশি।”
মেট্রো স্টেশনে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাকে আরেকটু সাজানে দরকার মত দিয়ে তিনি বলেন, “আপনাকে কেবল মেট্রো করলে হবে না, আপনার খুব ভালো ফিডার সংযোগ দরকার ও প্রবেশগম্যতা দরকার।
“ধরুন, ১০০-২০০ মিটারের মধ্যে যে যাত্রীটি আছেন, তিনি কীভাবে আসবেন, সেটা আমাদেরকে ভাবতে হবে। সে দিক থেকে আমাদের কিছু দুর্বলতা আছে। আমাদের প্রবেশগম্যতা ও কানেক্টিভিটি নাই। সুতরাং আমাদেরকে সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে।”
২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি মেট্রো লাইন করার পাশাপাশি ভালো ফিডার কানেক্টিভিটি করতে পারলে নেটওয়ার্কটাও ভালো হবে মত দিয়ে তিনি বলেন, “কেবল সাশ্রয়ী গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসাবে নয়, তার সঙ্গে অন্যদের সংযোগের বিষয়ও ভাবতে হবে।”
এত বেশি রেল দুর্ঘটনার কারণ ‘লোকবল সংকট ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা’য়
ইনসাইড আউটের শেষ প্রশ্ন ছিল রেল সেবার আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রমাগত দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে।
কেন এমনটি হচ্ছে- সেই জিজ্ঞাসার জবাবে হাদিউজ্জামান সামনে আনেন লোকবল সংকটের পাশাপাশি সিগন্যালিং সিস্টেমের অসামঞ্জস্য অবস্থাকে।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে রেলকে অবহেলা করা হয়েছে। আমরা রেললাইন বাড়ালেও ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি এসব অনেক পুরোনো। এখনো কিছু লোকোমোটিভ আছে, যেগুলোর জীবনকাল ফুরালেও চলছে।
“আমরা রেলওয়ে অবকাঠামোতে অনেক বিনিয়োগ করছি এবং সেখানে লোকবল ও স্মার্ট লোকবলের অভাব রয়েছে। সে কারণে খুব প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম লোকবল দিয়ে তারা চলছে।”
রেলওয়ে ফ্লাইওভার আর এক্সপ্রেসওয়ের মতো নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটাকে চালাতে হয় প্রতিদিন। পরিচালনার বিষয়টি আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, যেখানে লোকবলের দরকার।”
দক্ষ লোকবলের সংকট, আউটসোর্সিংয়ে প্রশিক্ষণহীন লোকরা কী কী কাজ করছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারা লেন পরিবর্তন, ক্রসিং এবং সিগন্যালের মতো অনেক সংবেদনশীল কাজ করছে।”
একেক জায়গায় একেক রকম সিগন্যালিং সিস্টেম আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোথাও কম্পিউটার ভিত্তিক ইন্টারলকিং সিস্টেম, কোথাও ম্যানুয়াল ইন্টারলকিং সিস্টেম এবং কোথাও ব্রিটিশ আমলের ইন্টারলকিং সিস্টেম কার্যকর আছে।
“এগুলো রেলওয়ে পরিচালনাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এ কারণে আমরা দেখি, কখনো কখনো দুই ট্রেন একই লাইনে এসে পড়েছে।”