“এগুলো তো আমাদের গৌরবের অংশ ছিল। সেখানে কারা হামলা করল?”
Published : 11 Aug 2024, 09:26 AM
সরকার পতনের পর থেকে দেশে ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন শিল্পস্থাপনা আক্রান্ত হওয়াকে সংস্কৃতির ওপর বড় ধরনের হামলা হিসেবে দেখছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাও একটি বড় কারণ বলে তারা মনে করছেন।
এই হামলার পেছনে উগ্রবাদীদেরকে দায়ী করেছেন তারা। কেউ কেউ বলছেন গণ আন্দোলনে ‘হুজুগে মানসিকতাকে’ কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ এই কাজটি করেছে।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ওই বিকেলেই প্রথম হামলার শিকার হয় রাজধানীর বিজয় সরণীতে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপ ৩২ নম্বর। ভাঙা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠদের ম্যুরাল।
এরপর গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বরের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে, ভাঙা হয়েছে ময়মনসিংহে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য এবং এই শহরেরই শতবছরের পুরনো শশীলজের ফোয়ারার মাঝখানে থাকা রোমান দেবী ভেনাসের ভাস্কর্যটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি খুবই দুঃখজনক এবং নিন্দনীয় কাজ হল। শত বছরের পুরনো ভাস্কর্যও রক্ষা পেল না। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করে সব নিদর্শন পুড়িয়ে দেওয়া হলো, লুট করা হল। এগুলো তো আমাদের গৌরবের অংশ ছিল। সেখানে কারা হামলা করল? সুনামগঞ্জে জাদুঘরে হামলা, এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”
তবে কিছু কিছু জায়গায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন শিল্প রক্ষা পেয়েছে, যা আশান্বিত করছে বলেও জানান অনেকে।
বেশি আক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য
গত এক দশকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে বহু ভাস্কর্য। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এই ভাস্কর্যগুলো।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর যে বাড়িটি ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার, সেই বাড়িতে কেবল হামলা চালিয়ে ভাঙচুরই করা হয়নি। জাদুঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তিনতলা বাড়িটি।
আগুন নেভার পর দেখা গেছে, জাতির পিতার বসবাসের ওই বাড়ির প্রতিটি কক্ষ পুড়ে গেছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ভবনের সামনের দিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশে রাখা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও।
আরও পড়ুন:
আক্রান্ত ভাস্কর্য-শিল্প স্থাপনা, সংস্কৃতিকর্মীদের কিছু প্রশ্ন
২২ জেলায় শিল্পকলায় হামলা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-চুরি
ওই বাড়িতে ১৯৯৪ সালে প্রথমে স্থাপন করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, পরে ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাস্কর্য ও আবক্ষ ভাস্কর্যও স্থাপন করা হয়। হামলায় এসব ভাস্কর্য পুরো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জাদুঘরের সামনের জায়গায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জায়গাটি দাঁড়িয়ে আছে পোড়া কালো ভগ্নদশা নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে তানজীম আহমেদ সোহেল তাজও বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আগুন দেওয়া এবং ভাস্কর্য ভাঙার নিন্দা জানিয়েছেন।
গত বুধবার ফেইসবুকে লাইভে বক্তব্যের এক পর্যায়ে সোহেল তাজ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ ও তার ভাস্কর্য ভেঙে দিয়ে আমাদের কতটুকু লাভ হলো?”
২০২৩ সালে ১০ নভেম্বর ঢাকার বিজয় সরণিতে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’ নামে একটি চত্বর উদ্বোধন করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে স্থান পায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মৃত্যুঞ্জয়’ নামে একটি ভাস্কর্য এবং বাঙালির বিভিন্ন সংগ্রামী অধ্যায়ের ম্যুরাল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্মিত ওই চত্বরের সাতটি দেয়ালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অন্যান্য আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও অবদান চিত্রিত করা হয়।।
সেখানেও হামলা চালানো হয়। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এবং ড্রিল মেশিন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি ভাঙা হয়। দেয়ালের ম্যুরালে কালি লেপন করে মুছে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি।
ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, দেশের নানা জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরালে আক্রমণ করা হচ্ছে।
তবে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের একটি ভাস্কর্য না ভেঙে তাতে ফুলের মালা পরানো হচ্ছে।
ওই বিকেলেই ময়মনসিংহ নগরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়। সংগ্রহশালার কর্মী ও উপস্থিত কিছু শিক্ষার্থী বিক্ষুব্ধ লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, জয়নুল আবেদিন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নন। এরপর ভাঙচুর বন্ধ করে তারা চলে যায়। পরে অবশ্য স্থানীয় চারুশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য মেরামত করা হয়।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে এই শহরের কেন্দ্রস্থলের শশীলজে হামলাকারীরা গিয়ে ফোয়ারার মাঝখানে থাকা রোমান দেবী ভেনাসের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে এর মুখাবয়ব নিয়ে যায়, আর বাকি অংশটি ফেলে রাখে ফোয়াররা পানিতে। ব্রিটিশ শাসনামলে রাজা শশীকান্ত ওই নান্দনিক ভাস্কর্যটি ইতালি থেকে গড়িয়ে এনেছিলেন।
১৯১১ সালে শশীলজ সংস্কার করেন রাজা শশীকান্ত। শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল ভেনাসের ভাস্কর্যটি। ভাঙা হয়েছে দিনাজপুরে সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু-কানুর ভাস্কর্যটিও।
কেন টার্গেট ভাস্কর্য?
শিল্পকর্ম সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নাসিমুল খবির ডিউক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার ভাস্কর্য শিল্পের উপর একটা বড় রকমের আক্রমণই হল। ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে তো একটা ধর্মান্ধগোষ্ঠী আগে থেকেই নানারকম প্রচারণা চালিয়েছে, আগেও হামলা করেছে। তবে এবারের মতো ব্যাপকভাবে আগে কখনো হয়নি।”
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার কেন প্রশ্নে অধ্যাপক ডিউক বলেন, “এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ব্যাপার আছে। তার সঙ্গে আরেকটি কারণও হতে পারে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক বেশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাস্কর্য হয়েছে, যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে।”
গুটিকয়েক মানুষ উস্কানি দিয়ে ভাস্কর্য ভাঙার কাজটি করেছেন বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক রশীদ আমিন।
তিনি বলেন, “এ দেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী আছে, কিন্তু এই দেশের বেশিরভাগ মানুষই উদারপন্থী। তবে তারা হুজুগে চলে। মানুষের হুজুগে মানসিকতাটাকেই কাজে লাগিয়ে কিছু সংখ্যক মানুষ এই কাজটি করেছে।”
অনেক জায়গায় ছাত্ররা হামলা প্রতিরোধও করেছে বলে জানান রশীদ আমিন।
তিনি বলেন, “মতিঝিলে শাপলা চত্বরের নাম শহীদি চত্বর করতে চেয়েছিল একদল লোক। ছাত্রদের প্রতিরোধে তা হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের কারণে হামলাও হয়নি। তবে সবাইকে আরও সোচ্চার হতে হবে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ব্যাপারে।”
শিল্পের স্বার্থে এবং সংস্কৃতির স্বার্থে সকল সংস্কৃতিকর্মীকে অবশ্যই শিল্পস্থাপনায় হামলার প্রতিবাদ করতে হবে বলে জানান প্রাচ্যনাটের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ও অভিনয়শিল্পী-নাট্যনির্দেশক আজাদ আবুল কালাম।
তিনি বলেন, “সংস্কৃতিকর্মীদের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য থাকতেই পারে। কিন্তু সংস্কৃতিকর্মীদের উচিত হবে কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির বাইরে থেকে ভাস্কর্যসহ শিল্পস্থাপনায় হামলার প্রতিবাদ করা।”
প্রতিবাদ
গত পাঁচদিনে ৭টি থিয়েটার দলের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং প্রাচ্যনাটের থিয়েটার কর্মী এবং জলের গানের মূল সমন্বয়ক রাহুল আনন্দের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে পুড়ে গেছে রাহুলের প্রায় কয়েকশ বাদ্যযন্ত্র।
এছাড়া সারাদেশে অন্তত ২২ জেলা ও উপজেলার শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা, ভাঙচুর করে সেখানে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় শিল্প একাডেমি।
জেলা-উপজেলার শিল্পকলা একডেমিতে হামলা চালিয়ে দুর্বৃত্তরা হারমোনিয়াম, তানপুরাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, কম্পিউটার, প্রজেক্টর, ক্যামেরাসহ মিলনায়তনের জিনিসপত্র ভাঙচুর ও লুট করে নিয়ে গেছে। কয়েকটি জেলায় সিসি ক্যামেরাও নষ্ট করা হয়েছে।
ভাস্কর্যসহ শিল্পস্থাপনায় হামলার প্রতিবাদ জানাতে গত বুধবার সেগুনবাগিচার জাতীয় নাট্যশালার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে 'বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। এতে অভিনয়শিল্পী, নাট্যনির্দেশকসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকে অংশ নেন।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী শুক্রবার সকালে প্রেস ক্লাবের সামনে ‘শিল্প স্থাপনা ও শিল্পাঙ্গন ধ্বংস রুখো’ শিরোনামে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
দেশের ঐতিহাসিক সম্পদ ও বৈচিত্র্য সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন 'দুনিয়াদারি আকাইভ' এবং 'বাংলাদেশ অন রেকর্ডের' এর পক্ষে ১৪ জন শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও সমাজকর্মী।
বিবৃতিতে তারা দেশের সকল এলাকার পাবলিক এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, জাদুঘর, আর্কাইভ, প্রত্নস্থল, বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এবং সংস্কৃতিকেন্দ্রসমূহের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা জোরদার করার দাবি জানান।
এছাড়া লুট হয়ে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও বিনষ্ট হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক নথি ও দলিলপত্র, শিল্পকর্ম, প্রত্নসামগ্রী, স্মারক ও উপকরণ পুনরুদ্ধার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করারও দাবি তুলেন।