দুদক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার সকালে তাকে হাজির হতে বলা হয়েছে।
Published : 23 Oct 2024, 08:59 PM
অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় কমিশনে হাজির হতে পদ্মা ব্যাংকের সাব্কে এই চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর তার তিনটি ঠিকানায় নোটিসটি পাঠানো হয়।
দুদকের উপপরিচালক ও নাফিস সরাফতের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মাসুদুর রহমান এ নোটিস পাঠান; যাতে বলা হয়েছে, “সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে আপনার বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা প্রয়োজন।''
মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগেই চিঠি পাঠানো হয়েছিল। বৃহস্পতিবার তাকে আসতে বলা হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক, আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারে বারবার প্রভাব খাটানোর অভিযোগ থাকা নাফিজ সরাফতের বিরুদ্ধে সরকার পতনের পর অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
তার বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, ''সাবেক চেয়ারম্যান পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রাহকের সাথে প্রতারণা ও নিজেদের মাধ্যমে একে অপরের যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ।''
নাফিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের দলের প্রধান দুদকের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান। অন্য দুই সদস্য হলেন- উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক রাকিব উদ্দিন মিনহাজ।
এ অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রথম দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দুদুকের আরেক উপপরিচালক ইসমাইল হোসেনকে। তবে তার বদলির কারণে অভিযোগ অনুসন্ধান দলের প্রধান করা হয় মাসুদুরকে।
নাফিস সরাফতকে তলব করার নোটিসে বলা হয়েছে, ''নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদানে ব্যর্থ হলে বর্ণিত অভিযোগ বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য নেই মর্মে গণ্য করা হবে।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতা হারানোর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে আর্থিক খাতের নানান অনিয়মে জড়িত থাকা ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে বারবার নাম আসায় খবর হয়েছেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফত।
সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও পুঁজিবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসির মালিকানাতেও যুক্ত। দুদকের অনুসন্ধানের উদ্যোগের পর তার প্রতিক্রিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত হোটেল ব্যবসা, বিদ্যুৎ, মোবাইলের টাওয়ার, মিডিয়াসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন গত এক দশকে।
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত; পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।
পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়, যা ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।
আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। ওই অবস্থায় ২০২০ সালে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তারা। আরেকটি প্রস্তাবে যোগান দেওয়া মূলধনের বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমপরিমাণ শেয়ার ইস্যু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে যে চিঠি দেয়, সেখানে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সঙ্গে ‘সমঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একমত হয়ে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদকে বলা হয়েছিল, বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা চালাতে। সেই চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়।
২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় কোম্পানিটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে তা বেড়ে ৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ নাফিজ সরাফাতের সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা।
পদ্মা ব্যাংকের দুর্দশা নিয়ে আলোচনার মধ্যে চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন নাফিজ। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত মার্চে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একভূত হওয়ার চুক্তি করে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদ।
সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান গত মে মাসে অভিযোগ তোলেন, নাফিজ সরাফাত তাকে কোনো এক রাতে সাবেক আইজিপি (ঘটনার সময় ছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক) বেনজীর আহমেদের বাসায় নিয়ে যান এবং সেখানে জোর করে তার কাছ থেকে সিটিজেন টিভির মালিকানার অংশ লিখে নেওয়া হয়।
২০২১ সালে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরের আঁকা একটি কার্টুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তোলে। চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে চিত্রায়িত করা ওই কার্টুনে নাভির জায়গায় দেখা যায় ব্যাংকের প্রতীক সিন্দুকের হাতল। তাতে ক্যাপশন ছিল, “আমি চৌ নাফিজ সারাফাত/জানি ব্যাংক খাওয়ার ধারাপাত!”
সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় বলা হয়, কিশোরের আঁকা ওই কার্টুনের উপরের ক্যাপশনটি লিখেছিলেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মুশতাক আহমেদ।
ওই বছর মে মাসে ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে মুশতাক, কিশোরসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বারবার জামিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে মৃত্যু হয় ৫৩ বছর বয়সী মুশতাকের। আর কিশোর জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন।