ফুলের গুচ্ছ, স্তবক আর মালা হাতে হাতে স্মৃতির মিনারে সালাম-বরকতের উত্তরসূরিরা; একুশের প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করছে দেশবাসী।
Published : 20 Feb 2024, 10:59 PM
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে রক্ত ঝরিয়ে জাতির স্বাধিকারের পথ সুগম করেছিলেন যারা সেইসব শহীদ ও সংগ্রামীরা স্মরণে উঠে এসেছেন রাতের প্রথম প্রহরেই; শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে অবনত চিত্তে।
বাঙালির গৌরবময় স্মৃতি, সেই সঙ্গে বেদনা আর বিদীর্ণ শোকের রক্তঝরা দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন পালিত হচ্ছে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিনও এটি। বছর ঘুরে সেই দিন স্মরণ করছে মাতৃভাষা প্রেমীরা।
দেশের সব শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন আর নানা আয়োজনে মহান এ দিন উদযাপনের সূচনা হয়েছে বুধবার প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে।
৭২ বছর আগের এ দিনে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতির মিনারে হাজির হয়েছে অগণিত মানুষ। প্রথম প্রহরেই ফুল হাতে ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে জড়ো হয়েছেন তারা।
গৌরবময় সেই অতীত স্মরণ রাতেই শেষ হবে না। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাত ফেরির মিছিল হবে পথে পথে।
শহর থেকে গ্রাম সবখানেই সেই মিছিল গিয়ে শেষ হবে একই জায়গায়। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে শহীদ মিনারের বেদি। কবি আল মাহমুদের ভাষায়, “প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ছড়াও ফুলের বন্যা/বিষাদগীতি গাইছে পথে/ তিতুমীরের কন্যা।“
ফুলের গুচ্ছ, স্তবক আর মালা থাকবে হাতে হাতে। কণ্ঠে মর্মস্পর্শী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...’।
ভোরের সেই প্রভাত ফেরির আগে একুশের প্রথম প্রহরে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বাজছিল অমর সেই গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…’।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবার প্রথমবার একুশের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মো. সাহাবুদ্দিন।
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে মোট ২১ বার শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রথম প্রহরেই শহীদ মিনারে শুরু হয়েছে শ্রদ্ধা জানানোর পালা, ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে স্মৃতির মিনার।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফুল দেওয়ার পর দলীয় নেতাদের নিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তারা ফুল দেওয়ার পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ফুল দেন শহীদ বেদীতে।
এরপর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ বিচারপতিরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা জানান মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা।
প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে এরপর তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান শহীদ বেদীতে ফুল দেন।
শহীদদের শ্রদ্ধা জানান ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতারা।
ঢাকার বিভিন্ন মিশনের কূটনীতিকরাও ফুল নিয়ে হাজির হন শহীদ মিনারে।
শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ঢাকার দুই সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম।
এবারও প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে অনুপস্থিত ছিল বিএনপি। তারা সকালে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে।
অন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথম প্রহরে ফুল দিয়ে স্মরণ করা হয় ভাষা শহীদদের।
সহকর্মীদের নিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।
গন্তব্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবদীপ্ত আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে রক্ত ঝরানোর নেশায় মেতেছিল বন্দুক হাতে মেতে উঠেছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে নির্বিচারে চলে গুলি। একে একে শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে।
ভাষার জন্য একমাত্র আত্মত্যাগের সেই শোক ও গৌরবময় দিনকে স্মরণে প্রতিবারের মতো এবারও ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আর আশপাশের এলাকা সেজেছে নান্দনিক সাজে। দেয়াল লিখন ও রঙিন আলপনায় ছেয়ে গেছে আঙ্গিনা।
এ দিবসকে সামনে রেখে একদল শিল্পী নানান চিত্রকর্মে রাঙিয়ে তুলেছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও তার আশপাশের প্রাঙ্গণ। দেয়ালের সঙ্গে পিচঢালা রাস্তাকে ক্যানভাস বানিয়ে রঙ-তুলির আঁচড়ে তুলে ধরা হচ্ছে ইতিহাস- মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষায় সংগ্রামের সেই ক্ষণ। সৌন্দর্য বাড়াতে শহীদ মিনারসহ আশপাশের রাস্তার দেয়ালে নতুন রঙ করা হয়েছে।
বাঙালির রক্তে অর্জিত দিনটি দেয়ালে দেয়ালে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের গৌরবগাথা, সংগ্রামের উত্তালের দিনগুলোর স্মৃতি মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাঙালি ও বাংলাকে উপজীব্য করে লেখা কবি-মনীষীর নানা পঙক্তি ও উক্তি শোভা পাচ্ছে সেখানে।
সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২১ বার পুষ্পস্তবক অর্পণের ছবি নিয়ে শহীদ মিনার এলাকায় এবার থাকছে বিশেষ প্রদর্শনী।
গান আর স্লোগানে মুখর এক দিন
বায়ান্নর সেই রক্তঝরা দিনে ভাষা সংগ্রামীদের মূলত তিনটি স্লোগান ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সেদিন ডাকা হয় ধর্মঘট। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে।
ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে হত্যার প্রতিবাদে সেদিনেই দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন চট্টগ্রামের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
তিনি লিখেছিলেন- ‘যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/ তাদের জন্য আমি ফাঁসি দাবি করছি/ যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য/ ফাঁসি দাবি করছি।” এটিই ছিল একুশ নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা।
অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে গিয়েছিলেন তখনকার ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী। মেডিকেলের বহির্বিভাগে তিনি ভাষা সংগ্রামী রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া লাশ দেখতে পান।
সংগ্রামী রফিকের নিথর দেহ দেখে আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখেন অমর কবিতা- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। প্রথমে আব্দুল লতিফ ও পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে সেই কবিতা হয় গান, যা এখন একুশে ফেব্রুয়ারি আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ।
মায়ের ভাষার সেই আন্দোলনকে দমাতে না পেরে শেষমেষ পিছু টান দেয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। এরপর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বাঙালির সেই আত্মত্যাগের দিন এখন কেবল আর বাংলার নয়, প্রতিটি মানুষের মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা আজ অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
২১ ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ ছুটির দিন। ভাষা শহীদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠান হবে। জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনেও অনুষ্ঠান হবে।
প্রতিবারের মত এবারও সাজ-সজ্জার দায়িত্বটি পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের ওপর। তাতে যোগ দিয়েছেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও।
একুশের শ্রদ্ধানুষ্ঠান ভাবগাম্ভীর্য ও শান্তিপূর্ণভাবে পালনের লক্ষ্যে সন্ধ্যা থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা করা হয়; পথ চলায়ও ছিল নিয়ন্ত্রণ।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। র্যাব ও গোয়েন্দারাসহ পুুলিশের বিশেষ ইউনিটগুলো তাদের দল মোতায়েন করেছে পুরো এলাকায়।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চায় যত্নবান হওয়ার আহ্বান
শোক ও বাঙালির স্বাধিকারের পথে এগিয়ে দেওয়ার গৌরবের এ দিনে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, “আমাদের স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অমর একুশের অবিনাশী চেতনাই যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা ও অসীম সাহস। ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথ বেয়েই অর্জিত হয় মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং সে ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় বাঙালির চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।“
তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির যথাযথ চর্চা ও সংরক্ষণে আরও যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানান।
এবারের ভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে ‘বহুভাষার মাধ্যমে শিক্ষা: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞান চর্চার স্তম্ভ’। মহান এ দিবসে পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রতিবাদ্যকে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত হিসেবে তুলে ধরে বলেছেন, বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।
রঙ-তুলির আঁচড়ে একুশের প্রস্তুতি
ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এ দিনে তিনি স্মরণ করেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিকদের।
তিনি বলেন, “জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বার বার কারাবরণ করেছেন। ভাষা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফরসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন এবং সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেপ্তার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পান। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।
“শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে নানা পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তিনজন দূত মারফত খবর পাঠান-২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে। শেখ মুজিব আমরণ অনশন ঘোষণা করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করে।“
একুশের কর্মসূচি
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রথম প্রহরেই শহীদ মিনারে শুরু হয়েছে শ্রদ্ধা জানানোর পালা, ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতির মিনার।
প্রথম প্রহরের কর্মসূচি শেষে ভোর থেকে সর্বস্তরের জনসাধারণ পলাশী মোড় হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের সামনের রাস্তা দিয়ে দোয়েল চত্বর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রাস্তা দিয়ে চাঁনখার পুল হয়ে বের হওয়া যাবে, শহীদ মিনারের দিকে আসা যাবে না।
প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারের পক্ষ থেকে দিবসটি ঘিরে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনসমূহে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সকল উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে রয়েছে- ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন। ভোর সাড়ে ৬টায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের সবগুলো শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন।
এছাড়া সকাল ৭টায় কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন। নিউ মার্কেটের দক্ষিণ গেট থেকে প্রভাতফেরি শুরু হবে। পরের দিন (২২ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৩টায় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সবগুলো কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ সব সহযোগী সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অন্যদিকে দিবসটি উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন তারা।
মঙ্গলবার দুপুরে শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু করেছে দলটি। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। এরপর ভোর ৬টায় প্রভাতফেরির জন্য বলাকা সিনেমা হলের কাছে নেতা-কর্মীদের জড়ো হবেন। জামায় কালো ব্যাজ লাগিয়ে প্রভাতফেরি করে প্রথমে আজিমপুরে শহীদদের কবর জিয়ারত করবেন তারা। এরপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির মত সারাদেশে জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ের দলীয় কার্যালয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং উত্তোলন করবে কালো পতাকা। এছাড়া প্রভাতফেরি করে স্থানীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। হবে আলোচনা সভাও।
এছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আরকাইভস্ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমি, বিরিশিরি, নেত্রকোণা, রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রন্থমেলা, আলোচনাসভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, সুন্দর হাতের লেখা ও রচনা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।