রঙ-তুলির আঁচড়ে একুশের প্রস্তুতি

সাফসুতরোর কাজ সারা হয়েছে আগেই। এখন দেয়াল লিখন ও রঙিন আলপনায় ছেয়ে যাচ্ছে আঙ্গিনা।

রাসেল সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2024, 06:21 AM
Updated : 20 Feb 2024, 06:21 AM

মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের গৌরবময় স্মৃতি, সেই সঙ্গে বিদীর্ণ শোকের রক্তঝরা দিন একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। 

বুধবার শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে দিনভর শহীদ মিনার মুখরিত থাকবে মানুষের ভিড়ে। শ্রদ্ধা আর ভালবাসার ফুলে ভরে উঠবে স্মৃতির মিনার। 

তাই শহীদ মিনার এলাকার দেয়াল আর পিচঢালা রাস্তাকে ক্যানভাস বানিয়ে রঙ-তুলির আঁচড়ে আলপনায় সাজিয়ে তুলছেন চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 

মঙ্গলবার সকালে শহীদ মিনার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সাফসুতরোর কাজ সারা হয়েছে আগেই। এখন দেয়াল লিখন ও রঙিন আলপনায় ছেয়ে যাচ্ছে আঙ্গিনা। নান্দনিক সাজসজ্জায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 

দেয়ালে দেয়ালে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের গৌরবগাথা, সংগ্রামের উত্তালের দিনগুলোর স্মৃতি। বাঙালি ও বাংলাকে উপজীব্য করে লেখা কবি-মনীষীর নানা পঙক্তি ও উক্তি শোভা পাচ্ছে সেখানে।

প্রতিবারের মত এবারও সাজ-সজ্জার দায়িত্বটি পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের ওপর। তাতে যোগ দিয়েছেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও। 

শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দেয়ালচিত্র আঁকায় মগ্ন চারুকলার অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের শিক্ষার্থী মুনজেরিন রিমঝিম বলেন, “যারা আমাদের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, পিচঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছেন, তাদের শ্রদ্ধা জানাতে এ কাজ করতে পারা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। দেশাত্মবোধ বা একুশের যে চেতনা, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর একটা সুযোগ হয় এই কাজের মাধ্যমে।” 

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ; ওই রক্তের দামে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি আর তার সিঁড়ি বেয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।

বাঙালির নেই আত্মত্যাগের দিন এখন কেবল আর বাংলার নয়, প্রতিটি মানুষের মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

আলপনা আঁকায় ব্যস্ত আরেক শিক্ষার্থী মঞ্জুর হোসেন বলেন, “একুশের আবহে আমরা আলপনায় বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। আজকের দিনে লাল ইটের বেদী, ইটের দেয়াল কিংবা পিচঢালা রাস্তা- সবই হয়ে উঠেছে আমাদের ক্যানভাস।” 

চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী জয়ন্তু মণ্ডল বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারির শোক আজ পরিণত হয়েছে বিশাল এক শক্তিতে। বাঙালির রক্তে অর্জিত এই দিনটি আজ সারা বিশ্বে পালিত হয়। তাই যেখানেই থাকি, এই দিনটি আসলে ছুটে আাসি এই প্রাঙ্গণে রক্তের আলপনা আঁকতে।” 

সার্বিক প্রস্তুতি জানিয়ে একুশে উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান বলেন, “একুশ উদযাপন আমাদের রাষ্ট্রীয় আচার ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব। আমরা ইতোমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলেছি। শহীদ মিনারের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে যাবতীয় কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে শতভাগ প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা করছি।”

নিরাপত্তার আয়োজন

একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনার ও আশপাশের এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। পাশেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাদে তৈরি করা হয়েছে ঘোষণা মঞ্চ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ প্রাঙ্গণে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কন্ট্রোল রুম, ফায়ার সার্ভিস ও প্রাথমিক চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকি দেখছেন না ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান।

সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। তারপরও পুলিশ সব ধরনের নিরাপত্তা হুমকি বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিয়েছে।

“শহীদ মিনারের অদূরেই বইমেলায় সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে পুলিশের একটি কন্ট্রোল রুম আছে। সেখানে ক্যামেরার মাধ্যমে সব ধরনের সিকিউরিটি ইকুইপমেন্ট এবং সিকিউরিটি ইউনিট কাজ করছে৷”

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, শহীদ মিনার এলাকায় সার্বক্ষণিক তল্লাশি ব্যবস্থা এবং পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে৷ ড্রোন পেট্রোলিং, মোবাইল পেট্রোলিং এবং সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷

একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতেও পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান তিনি।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ৩টা পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচল ও সব ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সন্ধ্যা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাস বা আইডি কার্ড ছাড়া প্রবেশও নিষিদ্ধ থাকছে।

২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সাধারণ ছুটি। ভাষা শহীদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা রাখা হয়েছে অর্ধনমিত।

শ্রদ্ধা নিবেদন

রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী, রাত ১২টা ১ মিনিটে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে প্রথম পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা। 

পর্যায়ক্রমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন তিন বাহিনীর প্রধান, ভাষা সৈনিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, অনুষদের ডিনবৃন্দ ও হলের প্রাধ্যক্ষবৃন্দ। এরপর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। 

এই রাষ্ট্রাচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে রাত ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। 

পথনির্দেশ 

সর্বস্তরের জনসাধারণ পলাশী মোড় হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে শহীদ মিনারে যাবেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। 

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের সামনের রাস্তা দিয়ে দোয়েল চত্বর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রাস্তা দিয়ে চাঁনখার পুল হয়ে বের হওয়া যাবে, শহীদ মিনারের দিকে আসা যাবে না। 

প্রবেশপথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউটস, রেঞ্জার ও স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন।