তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোতে নির্বাচন কমিশন শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অনেকের চোখে পড়লেও তা নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি কাড়ছে না।
Published : 08 Apr 2015, 12:36 AM
মঙ্গলবার প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু দেখে আগের প্রসঙ্গগুলো টেনে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় যথেষ্ট শক্ত অবস্থান দেখা যাচ্ছে না ইসির।
তার মতোই পর্যবেক্ষণ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের। বিধি ভঙ্গের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ‘অ্যাকশন’ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।
এসব বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের এড়িয়ে চললেও নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলছেন, সব সুন্দরভাবে চলছে।
২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের শুরু থেকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসছে। তবে ইসির পক্ষ থেকে বরারবই বলা হচ্ছে, রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ মঙ্গলবারও সাংবাদিকদের বলেন, “আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ রয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের। বিধি লঙ্ঘনের ব্যত্যয় সহ্য করা হবে না।”
তবে নোটিস দেওয়ার বাইরে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আর রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কথা বলে ইসির দায় এড়ানোর চেষ্টাও দেখছেন কেউ কেউ।
ভোটের প্রচার শুরুর আগে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি বৈঠক নিয়ে অভিযোগ জমা হয়েছে চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে।
ওই বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ নিতে পারেননি। কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা জানতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের শরণ নিয়েছেন তিনি।
গত মঙ্গলবার নগরীর জিইসি মোড়ের হোটেল পেনিনসুলার ওই বৈঠকে গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ছিলেন।
রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে প্রতিমন্ত্রী জাবেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “নির্বাচন নিয়ে দলীয়ভাবে বসছি। নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কথা হয়েছে।”
বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলমের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অভিযোগ আসার পর তদন্ত করে চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন গত ১ এপ্রিল ব্যবস্থার বিষয়ে নির্দেশনার জন্য ইসিতে চিঠি পাঠান।
ইসির আইন শাখা এ সংক্রান্ত চিঠি ও প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে বলে ইসির যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শাহজাহান জানিয়েছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু নির্বাচন কৌশল সংক্রান্ত এ বৈঠক হয়েছে সেহেতু তা আচরণবিধি লঙ্ঘন বলে পরিলক্ষিত হয়নি-এমন মতামত দেওয়া হচ্ছে।”
এক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দায় এড়ানোর অভিযোগের ভিত্তি স্পষ্ট হয় একজন নির্বাচন কমিশনারের কথায়।
“বিধি লঙ্ঘনে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের দরকার নেই। আইনি কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা দরকার হলে আমরা তা দেখব,” বলেন তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ভোট কৌশল নিয়ে এ ধরনের বৈঠক অবশ্যই আচরণবিধির লঙ্ঘন।”
সরকারি সুবিধা নিয়ে প্রচারণায় না যেতে আচরণবিধি প্রতিপালনে সহায়তা করতে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও ইসি চিঠি দিতে পারে বলে জানান তিনি।
বিলুপ্ত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদও বলেন, “অবশ্যই এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সমমর্যাদার ব্যক্তিদের সরকারি সুবিধা ব্যবহার করে ভোটের কাজ করায় নিষেধ রয়েছে।”
চট্টগ্রামে যা হয়েছে, তা ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ মন্তব্য করে সাখাওয়াত বলেন, “আমাদের সময়কালে ২০১০ সালে চট্টগ্রামে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান করতেই দেওয়া হয়নি।”
মঙ্গলবার প্রচার শুরুর দিন ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন বিশাল বহর নিয়ে নামেন। এর ফলে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে দেখা দেয় যানজট।
তোফায়েল বলেন, “তফসিল ঘোষণার পর থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন চলছে। পুরোপুরিভাবে বিলবোর্ড সরানোও হয়নি। মিছিল-শোডাউন করে প্রচারণা চলছে। একের পর এক ঘটনা ঘটছে, কোনো অ্যাকশন নেই।”
সাখাওয়াতের কথাও তাই- “প্রার্থীদেরও বিশাল বহর নিয়ে শোভাযাত্রা করায়ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমাদের সময়ে এসব করতেই দিইনি।”
চট্টগ্রামে পেনিনসুলার বৈঠকের আগে গত ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিনকে নিয়ে এক সভায় উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ।
বিএনপির অভিযোগের পর নাছিরকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তবে এই বিষয়ে বিধি ভঙ্গকারীদের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
ঢাকায় সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নোটিস দিলেও পরে তা হজম করে নেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ।
সাখাওয়াত বলেন, “কোথায় আচরণবিধি ভঙ্গ হচ্ছে, তা দেখার যেন কেউ নেই।”
বিপরীতে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ দাবি করছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মাঠে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাহী হাকিমরা তা তদারক করছেন।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাশ টেনে ভোটের লড়াইয়ে আসা বিএনপি শুরু থেকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। তাদের অভিযোগ, সবার সমান সুযোগ তৈরি করতে পারছে না ইসি।
তাদের অভিযোগের মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ ইসিকেই নিতে হবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, কোনো দল বা কোনো ব্যক্তি বা কোনো প্রার্থীর পক্ষে যায় এমন আচরণের সুযোগ নেই ইসির। ইসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ‘অ্যাকশন’ দেখাতে হবে।
ব্যবস্থা নেওয়া হবে- বললেই চলবে না, দৃশ্যমান কাজও বর্তমান ইসির কাছে দেখতে চাইছেন পূর্বসূরি সাখাওয়াত।
“আচরণবিধি প্রয়োগ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, সবার সমান সুযোগ তৈরি করা- এসবই বড় চ্যালেঞ্জ। কমিশনকে তা দৃশ্যমান করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকেই ভূমিকা নিতে হবে।”