ট্যাংকার ডুবে তেল দূষণ ছড়িয়ে পড়ার চার দিন পরও তা অপসারণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় দৃশ্যত বড় বিপদের দিকেই যাচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।
Published : 12 Dec 2014, 11:27 PM
হাঁড়ি পাতিল নিয়ে তেল সংগ্রহে গ্রামবাসী
সুন্দরবনের তেল অপসারণে ‘হাতুড়ে পদ্ধতি’
দুই দিন তেল ছড়ানোর পর উদ্ধার হলো ট্যাংকার
রাসায়নিক নিয়ে সুন্দরবনে কান্ডারি-১০
তেল ছড়িয়েছে আরও, দেখা মিলছে না ডলফিনের
তেলদূষণ: ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা, তদন্ত কমিটি
সুন্দরবনে শেলা নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় নদী ও অসংখ্য খালে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল তীর ও চরের মাটিতে যেসব স্থানে লেগেছে সেখানে নতুন করে চারা গজাবে না।
নদী সংলগ্ন এলাকায় এই ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের যেসব গাছপালায় তেল লেগেছে, সেগুলোও অক্সিজেন না পেয়ে ধীরে ধীরে মারা যাবে বলে মনে করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত, যিনি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সুন্দরবনের চরে আর কুমির দেখা যাচ্ছে না, পশুর নদী থেকে সরে গেছে অতিথি পাখি। উড়ে যাওয়া বকের সাদা ডানাও তেলের দাগে মলিন।
নদী আর খালে ভাসা থকথকে তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসেও। শেলা নদীতে মাছ মরার খবর এখনো পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন স্থানে তেলের স্তরে মরা কাঁকড়া আটকে থাকতে দেখা গেছে।
এই দূষণের মাত্রা কমানো না গেলে ওই এলাকার ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ যেমন মারা যাবে, তেমনি সার্বিক বাস্তুসংস্থান হুমকিতে পড়বে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নূরুল করিমের নেতৃত্বে গঠিত নয় সদস্যের তদন্ত দল শুক্রবার সুন্দরবনের শেলা নদীর জয়মনি থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখেন।
আগামী ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা সুন্দরবনে অবস্থান করবেন এবং সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ছড়িয়ে পড়া তেলের ক্ষতিকর প্রভাব এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরণে সুপারিশ করবেন।
৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি মঙ্গলবার ভোরে শেলা নদীর বাদামতলা এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়ার পর এ পর্যন্ত অগ্রগতি বলতে বৃহস্পতিবার থেকে সুন্দরবনের ওই পথে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধ হয়েছে এবং তেল আরও ছড়িয়ে পড়া আটকাতে দুর্ঘটনাস্থলের কাছে শেলা নদীর খালগুলোর মুখ জাল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয় গ্রামবাসীর সহায়তায় হাঁড়ি-পাতিল আর চটের বস্তা দিয়ে নদীতে ভাসমান তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদার ওই তেল ৩০ টাকা লিটার দরে কিনে নিচ্ছে।
এভাবে সারা দিনে ২৬ ব্যারেল, অর্থাৎ ৫ হাজার ২০০ লিটার তেল কেনা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া আরো অন্তত দুদিন চলবে এবং শনিবার মংলা বন্দর থেকে আরো দুটি নৌযান ও দশটি নৌকা এ কাজে যোগ দেবে বলে জানিয়েছেন এ ঘটনায় সার্বিক তদারকির দায়িত্বে থাকা নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম।
বন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই ‘অয়েল স্পিল ডিসপারস্যান্ট’ ছিটানো হচ্ছে না, যদিও ১০ হাজার লিটার রাসায়নিক নিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে শেলা নদীতে অবস্থান করছে টাগবোট কাণ্ডারি-১০।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চীনের তৈরি ওই রাসায়নিক গভীর সাগরে ছড়িয়ে পড়া তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশে কার্যকর প্রমাণিত হলেও সুন্দরবনের স্বাদু পানির প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য তা বিপদ বয়ে আনবে না এমন নিশ্চয়তা নেই।
এ কারণে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলে তবেই ওই রাসায়নিক ব্যবহারের কথা ভাবা হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার ঢাকা থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল আসছেন। তারা আমাদের খুলনার ল্যাবে অয়েল ডিসপারস্যান্ট পরীক্ষা করে দেখবেন- তা ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না।”
বনবিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ যার যার পক্ষ থেকে বিপদ কাটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেও তা কীভাবে করা হবে তা স্পষ্ট না হওয়ায় কোনো চেষ্টাই কার্যত এগোচ্ছে না।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও সচিব মো. নজিবুর রহমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে গত ১ ডিসেম্বর থেকে পেরুতে। মন্ত্রী দেশে ফিরবেন আগামী ১৭ ডিসেম্বর, আর সচিব আসবেন তারও দুদিন পর।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব তেল দূষণে অপূরণীয় ক্ষতির কথা বললেও তা কমিয়ে আনতে কী করণীয়, কীভাবে করণীয় তার কোনো স্পষ্ট ধারণা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাজে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদীতে যে ফার্নেস অয়েল পড়েছে তার ঘনত্ব অনেক বেশি। তেল বিস্তৃত হয়েছে নদীতে এবং চরের কিনারে। ঢুকে পড়েছে শাখা খালে। নদী সংলগ্ন এলাকায় যেসব গাছপালা রয়েছে তাতে তেল লেগে রয়েছে। এসব গাছপালায় এই তেলের কারণে অক্সিজেন পাবে না। ফলে তা আস্তে আস্তে মরে যাবে।”
তিনি জানান, গত দুই দিনে শেলা নদীতে যে পরিমাণ তেল ভাসতে দেখা গেছে শুক্রবার তা কমে এসেছে। এর অনেকটাই অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এবং শাখা খালে ঢুকে আটকে গেছে।
“আমার ধারণা, আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে ভাসমান তেল খুব একটা দেখা যাবে না। পানির সঙ্গে মিশে তলিয়ে যাবে। এটাই আমাদের পর্যবেক্ষণ।”
তবে এই তেল বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের কী কী ক্ষতি করে যাবে তা বোঝা যাবে আরো কয়েকদিন পর।
“এখনও আমরা নদীতে কোনো ধরনের মরা মাছ দেখতে পাইনি। মাছ যেহেতু এখনো মরেনি, তাহলে বুঝতে হবে মাছের বিচরণক্ষেত্র খুব একটা ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে পৌঁছেনি। ডলফিন খুব পলিউশন সেনসেটিভ প্রাণী। তাই হঠাৎ দুই একটা ছাড়া ডলফিন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না।”
“যেসব এলাকার গাছে বা চরের মাটিতে তেল লেগে রয়েছে সেখানে কোনো নতুন চারা গজাবে না। এই ক্ষতি রোধ করা যাবে না”, বলেন তিনি।
গত কয়েকদিন সুন্দরবনে অবস্থান করা বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির আবাসিক প্রতিনিধি রুবাইয়াত মনসুরও একই ধরনের কথা বলেছেন।
শুক্রবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মূল নদীর ধারায় ভাসমান তেল এখন আগের মতো দৃশ্যমান নয়। তার ধারণা, আগের রাতের ভাটার সঙ্গে এই তেল আরো অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে।
“বনবিভাগ তাদের সাধ্যমতো ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছে। তারা খালগুলোর মুখে নেট দিয়েছে। কিন্তু তার আগেই প্রচুর তেল খালগুলোতে ঢুকে পড়েছে এবং তা আরো ছড়িয়ে পড়ছে।”
তিনিও শুক্রবার শেলা নদীতে দুটি ইরাবতী ডলফিন দেখতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন, যা গত দুদিন দেখাই যায়নি।
তবে বুধবার থেকে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদীতে শীতের অতিথি পাখি দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ওই কেন্দ্রের রেঞ্জার আব্দুর রব।
তার ধারণা, শেলা থেকে পশুরে তেল ছড়িয়ে অতিথি পাখিরা স্থান পরিবর্তন করেছে।
প্রতিবছর শীত মওসুমে শীতের দেশ থেকে এসব পাখি সুন্দরবনে আসে। ছড়িয়ে থাকা খাল আর নদীতে এ সময়টা কাটিয়ে আবার ফিরে যায়।
“মঙ্গলবারও এসব পাখিকে পশুর নদীতে দেখা গেছে। কিন্তু বুধবার থেকে একেবারেই দেখা মিলছে না।”
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন শহীদুল ইসলাম।]