বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের শেলা নদীতে ট্যাংকারডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটার জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় দুই জাহাজ মালিকের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে বনবিভাগ।
Published : 10 Dec 2014, 11:54 AM
ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনের জলে ভাসছে তেল
শেলা নদীতে ট্যাংকার ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনে বিপর্যয়ের শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে নৌ মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে দুটি তদন্ত কমিটি।
ডুবে যাওয়া ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি উদ্ধারে বেসরকারি উদ্ধারকারী জাহাজ খানজাহান আলী এন্টারপ্রাইজ, যমুনা ও মংলার সহায়তায় বুধবার সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে এর মালিক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুণ অ্যান্ড কোং।
আপাতত দুটি জাহাজ দুই দিক থেকে সাউদার্ন স্টার-৭ কে আটকে রেখেছে, যাতে সেটি পুরোপুরি তলিয়ে না যায়।
এছাড়া নৌবাহিনীর দুটি এবং বিআইডব্লিউটি এর দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
সোমবারের মতোই ট্যাংকারটির সামনের অংশ নদীতে ডুবে আছে। পেছনের অংশ রয়েছে পানির ওপরে।
তবে জাহাজটির মাস্টার মোখলেসুর রহমানের কোনো খোঁজ বুধবার সকাল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন উদ্ধার অভিযানে থাকা কোস্ট গার্ড সদস্যরা।
ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে ‘টোটাল’ নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে।
মেসার্স হারুণ অ্যান্ড কোং এর ব্যবস্থাপক মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, ওই জাহাজের সাত ক্রু সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও মাস্টার মোখলেসুর রহমানের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ট্যাংকারটির প্রায় সব ফার্নেস অয়েল বেরিয়ে মঙ্গলবারই সুন্দরবনের শেলা নদীর অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বলে বন কর্মকর্তারা জানান।
বুধবার সকালে মংলা থেকে জয়মনি খেয়াঘাট হয়ে ট্রলারে করে শেলা নদীর বাদামতলা এলাকায় দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে নদীর দুই পাশের গেওয়া, কেওড়া ও বাইন গাছের গুঁড়িতে তেলের দাগ দেখা যায়। জোয়ারের সময় ভাসমান তেল লেগে থাকতে দেখা যায় তীরের মাটিতেও।
বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শেলা নদীতে যুক্ত খালগুলোতে ভেসে আন্ধারমানিক, নন্দবালা, জয়মনি, হরিণটানা এলাকার ছড়িয়ে পড়েছে তেল। রূপসা নদীতেও তেলের স্তর ভাসার খবর পাওয়া গেছে।
নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধারে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ এবং বরিশাল থেকে ‘নির্ভীক’ ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে টাগবোট কাণ্ডারী-১০ বাগেরহাটের পথে হয়েছে। তবে কুয়াশার কারণে নৌযানগুলোর পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে।
মন্ত্রী জানান, পানির ওপর থেকে তেল দূর করতে কাণ্ডারী-১০ থেকে গুঁড়ো রাসায়নিক ছিটানো হবে। এতে ভেসে থাকা তেল পানির নিচে চলে যাবে এবং পানির অক্সিজেন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমবে।
নৌবাহিনীর খুলনা অঞ্চলের কমান্ডার মনীর মল্লিক জানান, তাদের জাহাজ শাহপরাণ মংলা থেকে এবং জাহাজ আক্তারউদ্দিন হিরণ পয়েন্ট থেকে ঘটনাস্থলের দিকে গেছে। দুটি জাহাজে ১৬ জন ডুবুরি রয়েছেন।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে নৌবাহিনীর সদস্যরা সনাতন পদ্ধতিতে বাঁশ ও কলাগাছ ব্যবহার করে পানির উপরিতলের তেল আলাদা করে সরানোর চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।
যে জাহাজের ধাক্কায় ট্যাংকারডুবি হয়েছে সেই এমটি টোটাল (সি-১৮৫৪) নামের জাহাজটি সনাক্ত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান।
তিনি বলেছেন, ওই জাহাজের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।
ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ায় বন বিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মংলা থানায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা করেছেন। এমটি টোটাল ও সাউদার্ন স্টার-৭ এর মালিককে এতে আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, যাতে সদস্য হিসাবে আছেন বন বিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, ঢাংমারি স্টেশন কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র।
নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে আছেন ঢাকা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ। তিন সদেস্যের এই কমিটির বাকি দুজন হলেন- ঢাকা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নির্বাহী মেজেস্ট্রেট এবং স্পেশাল অফিসার (মেরিন সেফটি) গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসান।
খুলনার সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক মো. আবু জাফর মিয়াকে এই কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থাকে সনাক্ত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই কমিটিকে। তাদের আগামী ১৫ কার্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বন কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে পানিতে ভেসে থাকা এই জ্বালানি তেল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তেল দূষণের কারণে মৃগমারী-নন্দবালা-আন্ধারমানিক ডলফিন অভয়াশ্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের (যা শুশুক নামে পরিচিত) সবচেয়ে বড় বিচরণ ক্ষেত্র সুন্দরবন। শেলা নদী সংলগ্ন এলাকা এই জলজ প্রাণির অভয়াশ্রম হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষিত।
প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তেল যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে ডলফিন। অন্য জলজ প্রাণীও অক্সিজেন সঙ্কটে ভুগবে।”
শুধু ডলফিন নয়, শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের গাছপালা ও জলজ সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত।
তিনি বলেন, “এত পরিমাণ তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় প্রাণি বৈচিত্র্যের ওপর এর মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
“সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে অক্সিজেন নেয়। এই তেলের আস্তর জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হলে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে গাছ মারা যাবে।”
মংলার নালা ও রামপালের কুমার নদী ভরাট হয়ে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
তখন থেকেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শেলা নদীকে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির কারণে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এই নৌপথ বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে জয়মনির ঘোল এলাকায় সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার নিয়ে একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। তার আগে ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া এলাকায়ও ক্লিংকারবাহী একটি কার্গো ডুবে যায়। ওই জাহাজ দুটি এখনও ওঠানো সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, “সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষায় ওই চ্যানেল বন্ধ করা উচিত।”
তবে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের স্বার্থে এখনি তা বন্ধ করা যাচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, বন্ধ থাকা মংলা ও ঘষিয়াখালী চ্যানেল আবার চালু করা উদ্যোগ নেওয়া হবে।