নিম্নমানের নেটওয়ার্ক নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের।
Published : 21 May 2024, 01:03 AM
নিম্নমানের সেবা ও বছরের পর বছর লোকসানে থাকায় সংসদীয় কমিটির তোপের মুখে পড়লেন রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম হাবিবুর রহমান।
‘এ রকম প্রতিষ্ঠান থাকার দরকারটাই বা কী’- এমন প্রশ্নও করা হয়েছে তাকে। কোম্পানিটিকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের পিপিপি মডেলে চালানো যায় কি না, কথা হয়েছে তা নিয়েও।
সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে টেলিটকসহ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন টেলিটক এমডিও।
বৈঠকে উপস্থিত নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. নজরুল ইসলাম বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৈঠকে সরকারি টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পোস্ট অফিস নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার সময় টেলিটকের সেবার মান নিয়ে বৈঠকের সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
“সবাই জানতে চেয়েছেন টেলিটক কেন এই খাতের প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না।”
টেলিটকের এমডি কী বলেছেন, এই প্রশ্নে বাবু বলেন, “টেলিটকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের পুঁজি ও বিনিয়োগ কম।
“তবে আমরা বলেছি, সরকার চাইলে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু যে কোম্পানির কোনো ভিশন থাকে না, ফিউচার থাকে না, তাতে পুঁজি বিনিয়োগ করলে তা কাজে আসবে না।”
গ্রামীণফোন, বাংলা লিংকের মত বেসরকারি কোম্পানিগুলো মোবাইল ফোনের বাজারে আধিপত্য তৈরির মধ্যে টেলিটকের যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে।
তখনও টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ড ফোনের চল ছিল। বহু মানুষ ব্যবহার করত এই ফোনগুলোও। আর সে সময় টিঅ্যান্ডটি টেলিফোন থেকে ইনকামিংয়ে বিল কাটত কোম্পানিগুলো। টেলিটকই প্রথম কোম্পানি যারা ইনকামিং ফ্রি করে দেয়।
সিমের দামও তুলনামূলক কম রেখেছিল টেলিটক। এ কারণে তারা বাজারে আসার পর মাতামাতি তৈরি হয়। সিম কিনতে গিয়ে দীর্ঘ লাইন, এমনকি পুলিশের সঙ্গে মারামারিও হয় সে সময়।
টেলিটকের লক্ষ্য হিসেবে সে সময় দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাতের আধিপত্য বিস্তার করার কথা বলা হয়।
শুরুর দিকে সাশ্রয়ী প্যাকেজ দিয়ে গ্রাহকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহও তৈরি করতে পেরেছিল। সে সময় বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটররা মিনিটপ্রতি ৬ টাকা বিল নিত, আর কোনো পালস ছিল না। কিন্তু টেলিটকের বিল ছিল মিনিটে ৪ টাকা আর শুরু থেকেই ছিল পালসের ব্যবস্থা। ফলে পুরো মিনিট কথা না বললে সেই মিনিটের পুরোটার বিল দিতে হত না।
গ্রাহকদের মধ্যে দেশের টাকা দেশে রাখার স্লোগানও ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে না পারা এবং মানসম্মত ইন্টারনেট ও ভয়েজ সুবিধা দিতে না পারায় গ্রাহক সংখ্যা পড়ে হারিয়ে ফেলে টেলিটক। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ সরকারি বিভিন্ন সেবার মাসুল দিতে টেলিটক সিম ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য অনেকে এটি ব্যবহার করেন।
গ্রাহক না বাড়ার প্রভাব পড়েছে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্যে। গত ১৯ বছরের মধ্যে কেবল দুই বছর মুনাফার মুখ দেখেছে টেলিটক। পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০-১১ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে মুনাফা করতে পেরেছিল সরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরটি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের লোকসান হয় ১৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৭৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, “টেলিটকে বিনিয়োগের পরও কী কারণে গ্রাহক বাড়ছে না তা নিয়ে কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই কথা বলেন। তারা টেলিটকের নিম্নমানের নেটওয়ার্ক নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।”
তার ভাষ্য, “সংসদ সদস্যরা মত দিয়েছেন, টেলিটকের কর্মকর্তারা পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে না। সবার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব মনে হচ্ছে।
“টেলিটকের কর্মচারীরা বসে বসে সরকারি বেতন নেন কি না সে প্রশ্নও ওঠে ওই বৈঠকে।”
এ বিষয়ে কথা বলতে টেলিটক এমডি এ কে এম হাবিবুর রহমানকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
টেলিটককে লাভজনক করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কী কী করা যায়, তা নিয়েও কথা হয়। সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্বের পিপিপি প্রকল্প দেওয়ার কথাও বলা হয়।
তবে এ নিয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে কোনো সুপারিশ করা হয়নি।
নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, “বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান হলে ২৪ ঘণ্টাই তিনি প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তা করেন। কিন্তু টেলিটকের ক্ষেত্রে বিষয়টি এ রকম হয় না। তখন বৈঠকে বলা হয়, তাহলে এ রকম কোম্পানি থাকার দরকার কী?”
তিনি বলেন, টেলিটকের এমডি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
সংসদ সদস্য বাবু বলেন, বৈঠকে তাকে তাকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে।
“আমরা সবাই বসব, ত্রুটি বিচ্যুতি যাচাই বাছাই করে দেখব। সেই ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে প্রয়োজনে আমরা সম্মিলিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলব।”
দুটি উপ কমিটি গঠন
সংসদীয় কমিটি কোনো সুপারিশ না করলেও টেলিটকসহ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থাগুলো কীভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করানো যায়- এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম বাবু ও তারানা হালিমকে প্রধান করে দুটি উপ কমিটি গঠন করেছে।
বৈঠকের কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, সংসদীয় কমিটির আগের বৈঠকে টেলিটকের তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছিলেন এমডি। টেলিটককে লাভজনক করার কিছু পদক্ষেপের কথা বৈঠকে অবহিত করলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, “টেলিটকের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সরকার বিনিয়োগ করে কখনও লাভ করতে পারে নাই।”
তিনি টেলিটককে বাংলালিংকের সঙ্গে অ্যাকটিভ নেটওয়ার্ক শেয়ারিং/অ্যাকটিভ টাওয়ার শেয়ারিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার পক্ষে মত দেন।
এতে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান হতে রক্ষা পাবে বলেও মনে করেন পলক।
টেলিটক প্রতিনিয়তই ’প্রধানমন্ত্রীর নিকট ভুল তথ্য দিয়ে আসছে’ বৈঠকে এমন তথ্য তুলে ধরে সংসদীয় কমিটির কাছে সহযোগিতাও কামনা করেন প্রতিমন্ত্রী।
বৈঠকে টেলিটককে লাভজনক করার পদক্ষেপের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
কমিটির সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বি এম কবিরুল হক, আবদুল্লাহ নাহিদ নিগার, আবু সালেহ মোহাম্মদ নাজমুল হক, তারানা হালিম ও সিদ্দিকুল আলম।
আরও পড়ুন
বাংলালিংক ও টেলিটকের মধ্যে নেটওয়ার্ক ভাগাভাগি শুরু
টেলিটকে বিনিয়োগ করতে চায় বসুন্ধরা