নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন শান্তিপূর্ণ রাখা। কমিশনের আন্তরিকতার কোনো ‘কমতি নেই’।
Published : 21 May 2024, 01:40 AM
মোটামুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি কমছে। তারপরও আশা নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের দেড় শতাধিক উপজেলায় ভোটের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের এবারের ধাপে মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১৫৬ উপজেলায় একটানা ভোটগ্রহণ চলবে।
সেজন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ সব ধরনের সামগ্রী সোমবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছেছে। দুর্গম এলাকার ৬৯৭ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সোমবারই। বাকি ১২ হাজার ৩২৩ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছানো হবে মঙ্গলবার সকালে ভোট শুরুর আগে।
নির্বাচন কমিশনের আশা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও অনুকূল আবহাওয়ায় ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হলে ভোটের হার প্রথম ধাপের ৩৬.১ শতাংশের চেয়ে বাড়বে।
এ নির্বাচনে ‘গোলযোগ-সহিংসতা’ এ পর্যন্ত কম হলেও অনেক এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রার্থীদের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এসেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে কঠোর হতেও দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনকে।
ইতোমধ্যে দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দুজন ওসিকে। একজন মন্ত্রী ও একজন সংসদ সদস্যকে ইসিতে তলব করা হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ ভোট করতে প্রশাসন ও পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি। কোনো ধরনের অনিয়ম হলেই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, দ্বিতীয় ধাপের ভোট যাতে সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
“প্রথম ধাপের নির্বাচনেও তাই করেছি। আগামীকালের নির্বাচনও তেমন হবে। কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন শান্তিপূর্ণ রাখা। নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই।”
ভোট তথ্য
• ভোট: ১৫৬ উপজেলায়
• কেন্দ্র: ১৩ হাজার ১৬টি
• ভোটকক্ষ: ৯১ হাজার ৫৮৯টি
• ভোটার: ৩ কোটি ৫২ লাখ ৪ হাজার ৭৪৮ জন
• পুরুষ ভোটার: ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫ হাজার ৪৬৪ জন
• নারী ভোটার: ১ কোটি ৭২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭ জন
• হিজড়া ভোটার: ২৩৭ জন
• ২৪ উপজেলায় ইভিএমে ভোট
• বাকি ১৩২ উপজেলায় ভোট হবে ব্যালট পেপারে
• নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে ভোট করার সুযোগ থাকলেও ভোটকে আরো বেশি অংশগ্রহণমূলক দেখানোর কৌশলে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বা মনোনয়ন দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ফলে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও অর্ধশতাধিক উপজেলায় তাদেরও নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এমন অন্তত ৬৪ জনকে দল বহিষ্কারও করেছে বিএনপি।
গত ৮ মে ১৩৯ উপজেলায় প্রথম ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৩৬.১%। সিংহভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয় পর্বেও একই ফল হবে, তেমন ক্ষেত্রই প্রস্তুত হয়ে আছে।
ষষ্ঠ উপজেলা ভোটে দেশের মোট ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫ উপজেলায় চার ধাপে ভোট হচ্ছে এবার। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বাকিগুলোয় ভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। ২৯ মে তৃতীয় ধাপে ও ৫ জুন চতুর্থ ধাপের ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
# দ্বিতীয় ধাপে মোট ১ হাজার ৮২৪ জন প্রার্থী রয়েছেন।
# তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬০৩ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৯৩ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫২৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
# এ ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৮ জন ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭ জন, অর্থাৎ মোট ২২ জন প্রার্থী ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
# রাউজান ও কুমিল্লা আদর্শ সদর– এই দুই উপজেলায় তিনটি পদেই একক প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে এসব উপজেলায় ভোট করার প্রয়োজন পড়ছে না।
# স্থগিত, মামলা ও ধাপ পরিবর্তন হয়েছেন এমন উপজেলা- বাবুগঞ্জ, উজিরপুর ও বানারীপাড়া (চতুর্থ ধাপে), রুমা (প্রশাসনিক কারণে স্থগিত), মৌলভীবাজার সদর (মামলায় স্থগিত)।
# নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ থেকে ১৯ জন সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। বিশেষ এলাকায় (পার্বত্য ও দুর্গম এলাকা) সাধারণ কেন্দ্রে ১৯ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ থেকে ২১ জন সদস্য মোতায়েন থাকছেন।
# ভোটের মাঠে নিয়োজিত রয়েছেন ১৫৬ জন নির্বাহী হাকিম। উপজেলা ভিত্তিক বিচারিক হাকিমরাও নিয়োজিত থাকবেন।
ভোটার বাড়বে?
সবশেষ ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে। ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ৬১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে ৬৭.৬৯ শতাংশ ভোট পড়ে।
আর এবার প্রথম ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৩৬.১ শতাংশ, যা গত দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ-জানিপপ এর চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ বলেন, “এবারের উপজেলা নির্বাচন তো এক অভিনব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে সংসদ নির্বাচনে জামানত মাত্র ২০ হাজার টাকা, সেখানে চেয়ারম্যান পদে লাখ টাকা জামানত দিতে হচ্ছে প্রার্থীদের। সেই সঙ্গে দলের মনোনয়ন নেই। ভোট করতে পেশি ও অর্থের প্রভাবের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক স্থানীয় প্রভাবের বিষয়ও রয়েছে। আর একই দলের একাধিক প্রার্থী মাঠে রয়েছে।
“সব মিলিয়ে উপজেলা নির্বাচন প্রায় সহিংসতাহীন হলেও জামানত বেশি, স্থানীয় প্রভাব, টাকার প্রভাব আর একই দলের একাধিক প্রার্থীর দৌড়ের মধ্যে ভোটারদেরও কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে এক ধরনের অবসাদ এসেছে।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম মনে করেন, প্রথম ধাপে বিশৃঙ্খলা তেমন না হলেও ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। এবারও ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু থাকবে- সে চিন্তা থেকে ভোটকেন্দ্র গেলে এবার ‘হয়ত’ ভোটার বাড়তে পারে৷
“কিন্তু মানুষের এখন ভোট দেওয়ার আগ্রহই কমে গেছে। কারণ তারা পছন্দের প্রার্থী পাচ্ছে না হয়ত। প্রার্থী একাধিক থাকলে পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের একটা সুযোগ থাকে, যারা আসছে তাদের থেকে হয়ত পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ পাচ্ছে না৷
“আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রে প্রভাব থাকে, আবার আগে থেকে বুঝতে পারে কে জিতবে- সুতরাং আমি ভোট দিয়ে কী করব! এসব নানা চিন্তার কারণে ভোটারদের আগ্রহ কমছে৷”
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমও আশাবাদী, দ্বিতীয় ধাপের ভোটের পরিবেশ হয়ত ভালোই থাকবে। কিন্তু ভোটের হার নিয়ে তিনি আশাবাদী নন।
“সবার নজর থাকবে ভোটার উপস্থিতির দিকে। হয়ত ৩৬ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাবে, মানে দুই তৃতীয়াংশ ভোটবিমুখ। এটা অশনি সংকেত গণতন্ত্রের জন্য। এর পুনরাবৃত্তিই হয়ত দ্বিতীয় ধাপে দেখতে পাব।”
নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান অবশ্য বলেছেন, ভোটার উপস্থিতি বাড়তে মাইকিং করে ব্যাপক প্রচার চালানো হবে, যাতে করে ভোটাররা নির্ভয়ে কেন্দ্রে এসে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
“পেশি শক্তি এবং কালো টাকা দিয়ে কেউ প্রভাব বিস্তার কিংবা ঝামেলা করতে চাইলে পুলিশকে ডাকবেন, তারা ব্যর্থ হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে সেই সব কেন্দ্রগুলোতে পরে আলাদা করে ভোটের নেওয়া হবে।”
তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ভোটের হারের চেয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন।
তিনি বলেছেন, “নির্বাচনে কোনো বিধি-নিষেধ বা নিয়ম নেই যে, কত শতাংশ ভোট পড়লে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। ভোটাররা ভোট দিতে ইচ্ছুক। তারা কেন্দ্রে আসবেন। ধান কাটার মৌসুম, বৈরী আবহাওয়া, বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসছে না, এসব কারণে ভোটার উপস্থিতি কম।”
তার ভাষায়, “ভোটার কমও হওয়ার জন্য দায়ী কমিশনও না, অন্য কেউও না। কারণ হল বিভিন্ন কারণে ভোটাররা ভোট দিতে চান না। কেমন আবহাওয়া থাকবে, প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কেমন– এসবের ওপর নির্ভর করবে। ভোটের হার বেশি হলে আমরা খুশি, কিন্তু না হলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।”
পুরনো খবর
প্রচার শেষে ১৫৬ উপজেলায় মঙ্গলবার ভোটের অপেক্ষা
নতুন অভিজ্ঞতায় উপজেলার ভোট, সাড়া মিলবে তো?
ভোটার কম আসার ‘৫ কারণ’ দেখছেন ইসি আলমগীর
স্থানীয় নির্বাচনেও কেন ভোটের হারে ভাটা?
শান্তিপূর্ণ ভোটে স্বস্তি সিইসির