অভিশংসন নয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরছে বলে জানিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
Published : 09 Sep 2014, 05:39 PM
‘অভিশংসনের’ কথা বলে স্বার্থান্বেষী মহল ‘অপপ্রচার’ করছে বলেও আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির অভিযোগ।
বিচারপতিদের সরানোর ক্ষমতা আইনসভার হাতে ফিরিয়ে আনতে সংবিধান সংশোধনের বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বর্তমানে সুরঞ্জিত নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটিতে রয়েছে।
মঙ্গলবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এই নিয়ে আলোচনার পর কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সাংবাদিকদের বলেন, অপসারণ ও অভিশংসনকে এখানে একাকার করে ফেলেছে।
“স্বার্থান্বেষী মহল এমনভাবে অপপ্রচার করছে যাতে মনে হচ্ছে সরকার কোর্টকে নিয়ন্ত্রণ করতেই আইন করছে। কিছু দায়িত্বশীল ও অভিজ্ঞ নেতারাও এতে যোগ দিয়েছে।”
বিএনপি সংবিধান সংশোধনের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলছে, এর মধ্য দিয়ে সরকার বিচার বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
সুরঞ্জিত বলেন, “যারা এটা (অপপ্রচার) করছেন, তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দূরভিসন্ধিমূলক কথা বলছেন।”
“এখানে অভিশংসনের কোনো প্রশ্নই নেই। অভিশংসন শুধু রাষ্ট্রপতির জন্য। তাও কেবল রাষ্ট্রপতি যদি গুরুতর অসদাচরণ কিংবা সংবিধান লঙ্ঘন করেন,” বলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম সুরঞ্জিত।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ ও তাদের সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।
চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
এখন সংবিধান সংশোধন করে আবার সংসদের হাতে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চাইছে আওয়ামী লীগ। সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় উত্থাপিত বিলটি পরীক্ষা করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে সংসদীয় কমিটিকে বলা হয়েছে।
“আর অপসারণ সকল বিচারপতির নয়, যারা অসদাচরণ করবেন কিংবা অসামর্থ্য হবেন তাদের অপসারণ। এদের হাত থেকে বিচার বিভাগ বাঁচতে চায়। যে কাজ করতে পারে না, তাকে কি রাখা উচিৎ? পাগলকে রাখতে হবে?”
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সংসদের হাতে এই ক্ষমতা থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ না হওয়ার কথা তুলে ধরে তৎকালীন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত বলেন, “বরং সামরিক শাসকই বিচারপতি কে এম সোবহান এবং কামালউদ্দিন আহমেদদের সরিয়েছিল।”
সংসদে উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবে, কোনো বিচারপতির অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে ‘তদন্ত ও প্রমাণ’ আইন করে সংসদের নিয়ন্ত্রণ করার শর্ত রাখা হয়েছে।
সুরঞ্জিত বলেন, “কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ ওঠে তাহলেই কি তাকে অপসারণ করা হবে? তা নয়। এর জন্য ফলো-আপ আইন হবে। ওই আইনে তদন্ত কমিটির বিধান থাকবে। সংশ্লিষ্ট, দায়িত্বশীল, প্রাসঙ্গিক লোকদের দিয়ে করা হবে।
“তারা সংসদে বিষয়টি পাঠালে সংসদ শুধু অনুমোদন দেবে। অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। তিনিই নিয়োগ দেন, সরাবেনও তিনি।”
সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি আর সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন।
আইন না করা পর্যন্ত সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টির কোনো আশঙ্কা থাকছে কি না- জানতে চাইলে সুরঞ্জিত বলেন, “এতদিন কী ছিল? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি কাউকে অপসারণ করেছে?”
বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে যে কমিটি করা হবে, সেখানে কারা থাকবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা আইনেই বলা থাকবে।
“এতদিন অভিযুক্ত, তদন্তকারী, বিচারক একই লোক। তাহলে কি সুবিচার হয়? দেখতে হবে সকলে মিলে যাতে কমিটি হয়।”
প্রস্তাবনা বাদ দেওয়া হবে
সংসদে উত্থাপিত বিলের ‘প্রস্তাবনা’ অংশ বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সংসদীয় কমিটির সব সদস্য একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুরঞ্জিত।
“ছোট্ট সংশোধনী, এতবড় প্রস্তাবনার দরকার নেই। এর আগে শুধু ১২ ও ১৩তম সংশোধনীতে প্রস্তাবনা ছিল। এখানে প্রস্তাবনা অসঙ্গতিপূর্ণ ও অসাঞ্জস্যপূর্ণ। এটা বাদ দিতে আমরা সবাই একমত হয়েছি।”
বিলটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মত নিতে চায় সংসদীয় কমিটি। এই বিষয়ে সরকারের মতামত চেয়েছে তারা।
সুরঞ্জিত বলেন, “আমরা আইনমন্ত্রীকে বলেছি। তিনি সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন। তারা যদি স্পেস দেয়, তাহলে আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগের এই নেতা কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, বিলটি তার কমিটিতে এলে তিনি সুপ্রিম কোর্ট, বার কাউন্সিলের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকেও ডাকবেন, তাদের মতামত শুনবেন।
বিচারপতিদের সমমর্যাদার সাংবিধানিক পদধারীদের বিষয়ে ‘অস্পষ্টতার’ বিষয়ে সুরঞ্জিত বলেন, “তাদের জন্যই একই কথা। তবে তাদের জন্য আইন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, সংবিধানের ১১৮, ১২৯ ও ১৩৯ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষেত্রে যেসব কারণ উল্লেখ রয়েছে, সেগুলো ছাড়া সমমর্যাদার সাংবিধানিক পদধারীদের অপসারণ করা যাবে না।
অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অপসারণ বিচারপতিদের ন্যায় একই পদ্ধতি ও কারণে হবে।