সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি কমলেও মধ্যাঞ্চলে বাড়ছে এখন। তবে বৃষ্টিপাত কমায় মধ্যাঞ্চলে বন্যার দুর্ভোগ ব্যাপক হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য মাসের শেষ দিকে ফের বৃষ্টি বাড়ার আভাস রয়েছে, যা পরিস্থিতি আবার অবনতির দিকে ঠেলে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
Published : 22 Jun 2022, 01:01 AM
টানা ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে গত সপ্তাহে বর্ষার শুরুতেই ভয়াবহ বন্যায় ডোবে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। ভারতের মেঘালয় ও আসামে প্রবল বৃষ্টিপাতই এই পরিস্থিতি তৈরি করে।
এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি বেড়ে কুড়িগ্রামসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল এখন কম-বেশি প্লাবিত।
বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে গত প্রায় এক মাসে পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে এবং বজ্রপাতে ৩৬ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। অন্যদিকে দুর্গতদের খাবার ও আবাস সঙ্কটও উঠেছে চরমে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ভারি বর্ষণ না থাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। তবে শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের নদীগুলোর ১০৯টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৬৮টিতে পানি বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে ৯টি নদীর পানি।
কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উত্তর পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, নদ-নদীর পানি কমছে। এ অঞ্চলে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। তবে নতুন করে আরও অবনতির শঙ্কা নেই। মধ্যাঞ্চলের দিকে পানি বাড়ছে, এ জন্য দুয়েকদিনের জন্য অল্প কয়েকটি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
“বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসছে। সেই সঙ্গে উজানেও ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা কম। উজানে পানি বাড়লেও অল্প বাড়তে পারে। উজান থেকে যেহেতু মধ্যাঞ্চলে পানি নামছে, সেহেতু গুরুতর বন্যার আর আশঙ্কা নেই।”
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনকার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী কয়েকদিন কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাত নেই। সুখবর হচ্ছে-উপর দিক থেকে বন্যার যে পানিটা আসছে, সেটা কমে যাবে বিশেষত সিলেট অঞ্চলে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায়ও ভারি বৃষ্টি নেই। যার ফলে উপরের পানিটাও ধীরে ধীরে কমে আসবে।”
তার মতে, বন্যাটা তখন উত্তর, উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চলে ও এর নিম্নাঞ্চলের দিকে যাবে। সোজা কথা হচ্ছে- সিলেট, সুনামগঞ্জ হয়ে নিচের দিকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারার পানি এখন বিপৎসীমার উপরে থাকলেও তা নিচে নামবে মধ্যাঞ্চল হয়ে। কিন্তু বৃষ্টি কমলে সেই পানির মাধ্যমে আরও বেশি এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা কমবে।
সাইফুল বলেন, “চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ের বৃষ্টি কমে গেছে। এখন আস্তে আস্তে এ পানিটা (সিলেট অঞ্চলের) নিচের দিকে নামবে। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর- এভাবে আস্তে আস্তে পানি কমে আসবে। (আরও সপ্তাহ খানেক পরে) পানি কমে স্বাভাবিকভাবে মানুষ বাড়ি ঘরে ফিরে যেতে পারবে।”
তবে সামনে ফের বৃষ্টিপাতের আভাস থাকার কথা জানিয়ে বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, “২৮ জুনের দিকে আবার বৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে এ বন্যাটা এখন যদি কমেও, পরবর্তীতে আবার হয়ত আমরা আরেক দফা বন্যা দেখতে পাবো। এ বন্যাটা শেষ হয়ে গেছে, এমন বলতে পারব না।”
বাংলাদেশের নদীতে পানি বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে যে পয়েন্টগুলো দিয়ে বন্যা আসে, ট্রান্সবাউন্ডারি ৫৭টি রিভারের ৫৪টাই আসে ভারত থেকে। প্রধান অববাহিকার ৯০% দেশের বাইরে। বাংলাদেশের পানি দেশের বাইরে থেকেই বেশি আসে। বাইরে হলেও স্লোপ ও হিলি রিজিয়নের কারণে পানি দ্রুত নামে।”
বন্যাজনিত কারণে এক মাসে ৩৬ মৃত্যু
দেশের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে গত প্রায় এক মাসে পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে ও বজ্রপাতে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। বজ্রপাতে ১২ জন, সাপের কামড়ে একজন এবং অন্যান্য কারণে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, মৃতদের ১৮ জন সিলেট এবং ১৫ জন ময়মনসিংহ বিভাগের। রংপুর বিভাগে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৭ মে থেকে ২০ জুন পর্যন্ত বন্যার কারণে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৯৩৪ জন।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ১৭৯ জন ডায়রিয়ায় ভুগেছেন। আর বজ্রপাতে ১৩ জন, সর্প দংশনে ৪ জন, পানিতে ডুবে ১৯ জন আহত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সাপের কামড়ে ১ জন এবং পানিতে ডুবে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৩১৫ জন।
পানি দ্রুত নামার পথ করতে হবে
অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাংলাদেশে বৃষ্টি হবেই, তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পানি সরার পথ রাখতে হবে।
“বন্যাপ্রবণ দেশে বন্যার সঙ্গে বসবাস করতে হবে। বন্যাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। তবে বন্যা ব্যবস্থাপনাটা এমন হতে হবে, যেন বন্যা আমাদের সবচেয়ে কম ক্ষতি করে।”
এবারের বন্যার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, “আগে থেক্বে দেখা যাচ্ছে পানি একটু আস্তে নেমেছে। আরও স্টাডি করলে দেখা যাবে, পানি কোথায় আটকে যাচ্ছে।
“আগামীতে পরিকল্পনার মাধ্যমে একটা টেকনিক্যাল টিম গঠন করে দেখা দরকার, হাওরের পানি নামতে বাধা কোথায়। সে জায়গাগুলোয় কালভার্ট, ব্রিজ, উড়াল সেতু করে দিতে হবে।”
জলাধার ভরাট ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “ডিটেইল স্টাডি দরকার। অনেক রাস্তাঘাট, অনেক স্থাপনা, ফ্যাক্টরি, মিল হয়েছে। সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে পানি প্রবাহের কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। এখন থেকে এ জিনিসগুলো সাধারণ মানুষের মাথায় রাখতে হবে।”
“এ বন্যার পর বন্যা ব্যবস্থাপনায় আমাদের চিন্তা করতে হবে নদীর যে নাব্যতা হারিয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে সেখান দিয়ে দ্রুত পানি নামতে পাবে। এমন কোনো স্থাপনা করা যাবে না, যেটা বন্যার পানি প্রবাহে বাধা তৈরি করে,” বলেন তিনি।
শহরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রক্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো শক্তিশালী করার উপর জোর দেন তিনি।
বন্যা কবলিত হওয়ার পর চিন্তা না করে অন্য সময়ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ভাবার পরামর্শ দেন অধ্যাপক সাইফুল।
তিনি বলেন, “আমাদের যেন এমন না হয়, বন্যার সময় শুধু বন্যা নিয়ে চিন্তা করে। এটাতে কিছু এ এলেও পরবর্তী সময়ে আবার সেই একই হাহাকার। সেটা করা যাবে না।”