আসামের বন্যায় ধ্বংস হচ্ছে লাখো ঘর, স্বপ্ন

ভারতের উত্তরপূর্বে রাজ্য আসাম ভয়াবহ বন্যায় তুমুল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ঘরবাড়ি হারানো লাখ লাখ মানুষ স্বপ্ন দেখার জোরটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।  

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2022, 09:31 AM
Updated : 22 June 2022, 06:23 AM

“সর্বত্রই পানি, অথচ খাওয়ার জন্য নেই এক ফোঁটাও,” শনিবার বাড়ির বাইরের দৃশ্য আর নিজেদের করুণ পরিস্থিতিকে এই এক বাক্যেই তুলে ধরার চেষ্টা করলেন রঞ্জু চৌধুরী।

আসামের প্রত্যন্ত গ্রাম উদিয়ানায় এ নারী জানান, কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণের পর পানি হুট করে এত বেড়ে যায় যে মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে সড়কগুলো পুরোপুরি ডুবে যায়।

পানি যখন তাদের ঘরে ঢুকে, নিজেদের নিরাপদ রাখার চেষ্টায় পরিবারের সদস্যরা তখন হুড়োহুড়ি করে অন্ধকারের মধ্যেই বাড়ির এক জায়গায় চলে আসেন। এরপর থেকে দুইদিন ধরে সেই বাড়িতেই পড়ে আছেন তারা, যেটিকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের মধ্যে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ।

“আমাদের চারপাশেই বন্যার পানি। খাওয়ার পানি নেই বললেই চলে। খাবারও শেষ হয়ে আসছে। এখন শুনছি, পানি নাকি আরও বাড়ছে। কী হবে আমাদের?,” বলেছেন রঞ্জু।

গ্রামের পর গ্রাম ডুবিয়ে, বিপুল পরিমাণ জমির ফসল নষ্ট এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবারের নজিরবিহীন বৃষ্টিপাত ও বন্যা আসামজুড়ে ধ্বংসের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। বৃষ্টি-বন্যায় রাজ্যটির ৩৫টি জেলার ৩২টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রাণ গেছে অন্তত ৪৫ জনের, ঘর ছাড়তে হয়েছে ৪৭ লাখের বেশি মানুষকে; জানিয়েছে বিবিসি।

আসামের পাশাপাশি প্রতিবেশী মেঘালয়ও তুমুল বৃষ্টি দেখেছে, সপ্তাহখানেকের মধ্যে রাজ্যটির অন্তত ১৮ জনের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আসামের সরকার উদ্বাস্তুদের জন্য এক হাজার ৪২৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খুললেও বিপর্যয়ের মাত্রা এমনই যে তাতেও কাজ হচ্ছে না। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর অবস্থাও বেহাল।

“আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার পানি নেই। আমার ছেলের জ্বর, কিন্তু তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারছি না,” বলেছেন উদিয়ানারই আরেক বাসিন্দা হুসনা বেগম।

বুধবার পানি যখন তাদের বাড়ি ডুবিয়ে দেয়, ২৮ বছর বয়সী এ নারী তখন সাহায্যের খোঁজে তীব্র স্রোতের মধ্যেই সাঁতরাতে শুরু করেন।

হুসনা এখন তার দুই সন্তানকে নিয়ে কোনোরকমে তৈরি করা একটি প্লাস্টিকের তাঁবুতে থাকছেন।

“এমনটা আগে কখনো দেখিনি। এত বড় বন্যা আমি জীবনেও দেখিনি,” বলেন তিনি।

আসামের ‘প্রাণ’ খ্যাত প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্রের উর্বর তীরের কাছে যে লাখ লাখ মানুষের বাস বন্যা তাদের কাছে অপরিচিত না হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন, নজরদারিহীন নির্মাণ ও দ্রুত শিল্পায়নের মতো কারণগুলো চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের তীব্রতা ও পরিমাণ বাড়াচ্ছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হল আসাম। এর আগে মে-র বন্যা রাজ্যটির অন্তত ৩৯ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

উত্তরপূর্বের এ রাজ্যটি এরই মধ্যে জুনের গড় বৃষ্টির চেয়েও ১০৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টি দেখে ফেলেছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। অনেক এলাকায় এখনও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে।

এবারের বন্যার প্রভাব এতটাই মারাত্মক যে তা রাজ্যের সমাজ-অর্থনীতি ওলটপালট করে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও বাসিন্দাদের।

“এবারের পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। জাতীয় দুর্যোগ প্রতিরোধ বাহিনীর (এনডিআরএফ) পাশাপাশি উদ্ধার অভিযানে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে জীবন বাঁচানো,” বলেছেন রাঙ্গিয়া শহরের এক মহকুমা কর্মকর্তা জাভির রাহুল সুরেশ।

বন্যার পানি একের পর এক এলাকা ডুবিয়ে দেওয়ার পর এখন আসামের অনেক অঞ্চলকে দেখে মনে হচ্ছে যেন রাতারাতি কোনো বড় নদীর আবির্ভাব ঘটেছে।

আসামের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র গুয়াহাটির বিভিন্ন এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাজ্যের যেসব জমিতে ধান হতো সেখানে এখন কাদা আর জঞ্জাল।

উদিয়ানায় কোনো স্কুল, হাসপাতাল, মন্দির বা মসজিদ চোখে পড়ে না, কেবল পানি আর পানি। মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে কলাগাছ ও বাঁশ দিয়ে বানানো ভেলায় করে। অনেককে বাদামি-সবুজ লালাভ জলে সাঁতার কাটতে হচ্ছে। উজ্জ্বল কমলা রংয়ের ইউনিফর্ম পরিহিত উদ্ধারকর্মীদের দেখা পেলেই তাদের চোখগুলোতে আলোর ঝিলিক খেলে যাচ্ছে।

কামরূপ জেলার পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক, সেখানে কয়েকশ লোক এখনও তাদের ঘরেই আটকা পড়ে আছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।  

৬৪ বছর বয়সী সিরাজ আলী জানান, যখন পানি তাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং সবকিছু ধ্বংস করতে থাকে, তখন নিজের জীবন নিয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তারপরও নিজেদের জিনিসপত্র ও ‘আজীবনের স্মৃতি’ পাহারা দিতে তিনি বাড়িতে থাকারই সিদ্ধান্ত নেন, যার একাংশ এখন পানির নিচে।

ছেলেমেয়েদের কাছের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়ে বাড়িতে থাকা এ ষাটোর্ধ্ব কখন সাহায্য আসবে সে অপেক্ষায় আছেন; এখন পর্যন্ত কারও দেখাই পাননি তিনি।

“পানির কারণে আটকা পড়ে আছি, কিন্তু খাওয়ার পানি নেই। খাবার নেই। তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত। কী করবো, কোথায় যাবো?” জিজ্ঞাসা কান্নায় ভেঙে পড়া সিরাজের।

তিনি এখন সান্ত্বনা খুঁজছেন প্রতিবেশী রুবুল আলীর উপস্থিতিতে। দিনমজুর রুবুলও নিজের বাড়ি রক্ষায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিজের ছোট্ট কুঁড়েটি অনেক কষ্ট করে বানিয়েছেন রুবুল। 

“প্রত্যেকটা জিনিস অনেক কষ্ট করে কিনেছিলাম। সাইকেল, বিছানা, চেয়ার। কিন্তু এখন কিছুই নেই। বন্যা আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছে,” বলেছেন তিনি।

কর্তৃপক্ষও বন্যা আক্রান্ত সবার কাছে খাওয়ার পানি ও খাবার সরবরাহ না করতে পারার কথা স্বীকার করে নিয়েছে।

“পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কিছু কিছু এলাকায় পৌঁছানো আমাদের জন্য এখনও চ্যালেঞ্জের। সেসব এলাকায় যাওয়ার সড়কপথগুলো পানিতে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে,” বলেছেন সুরেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যা মোকাবেলায় অগ্রগতির ক্ষেত্রে রাজ্যের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাহত হলেও এই দুর্যোগের পেছনে আরও অনেক ‘ফ্যাক্টর’ও আছে।

“এবারের বন্যা পরিস্থিতি যে মারাত্মক এবং বৃষ্টির পুনরাবৃত্তি যে ক্রমশ বাড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একে পুরোপুরি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার আগে আমাদের বন ধ্বংসের মতো মানবসৃষ্ট ফ্যাক্টরগুলোকেও বিবেচনায় নেওয়া দরকার,” বলেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জয়শ্রী রাউত।

তার মতে, বড় বড় গাছ, বিশেষ করে নদীর কাছে থাকা গাছ, যেগুলোর শেকড় পানি ধরে রাখতে পারে, সেগুলো কেটে ফেলা বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।

তবে এ ধরনের কারণ বিশ্লেষণের সময় নেই রঞ্জু চৌধুরীদের।

শনিবার, উদিয়ানার মেঘলা দিগন্তে যখন সূর্য ডুবছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সেসময় তিনি তার অর্ধনিমজ্জিত বাড়ির বাইরে উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিলেন।

“এখন পর্যন্ত ত্রাণের নামে কেউ আমাদের কিছু দেয়নি। কেউ কি আদৌ আসছে?,” আকূল জিজ্ঞাসা তার।