সার্চ কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আরেক ধাপ এগোল নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া; কিন্তু আইন হওয়ার পর অনুসন্ধান কমিটি গঠনে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যাওয়ায় এখন সামনে আসছে সময়ের প্রশ্ন।
Published : 06 Feb 2022, 01:19 AM
বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন কমিশন গঠন হচ্ছে তো? কী হবে যদি তা না হয়? সাময়িকভাবে ইসি কয়েক দিন শূন্য থাকলে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা তৈরি হবে?
সংসদে বিল পাসের পর গত ৩০ জানুয়ারি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন- ২০২২’ এর গেজেট প্রকাশ করে সরকার।
ছয় দিন অপেক্ষার পর শনিবার ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির নাম ঘোষণা হয়েছে, যার নেতেৃত্বে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। খুব শিগগির কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতে সভা করার কথাও তিনি জানিয়েছেন।
এবারই প্রথম আইনের আওতায় সার্চ কমিটি করে নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের বেছে নিচ্ছে বাংলাদেশ। আইন অনুযায়ী, এই সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে দশজনের নাম প্রস্তাব করার জন্য ১৫ কার্যদিবস সময় পাচ্ছে। সেখান থেকে বেছে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু সিইসি কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। আর সেখানেই সময় নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
বর্তমান ইসির মেয়াদপূর্তির আগেই নতুন ইসি চূড়ান্ত করতে হলে হাতে থাকছে আর নয় দিন। সার্চ কমিটির সদস্যরা তা করতে না পারলে ইসি শূন্য থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বিষয়গুলো বুঝতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলেছে সার্চ কমিটির সভাপতি এবং এবং ইসির সাবেক সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
সার্চ কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আমি আইনের যেভাবে রয়েছে সেভাবে নির্ধারিত ১৫ দিনের মধ্যে কাজ করার চেষ্টা করব। আমরা স্বল্পতম সময়ে কমিটির সবার সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরু করবো।”
আর সেজন্য যদি ১৪ ফেব্রুয়ারি পেরিয়েও যায়, অর্থাৎ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের পদ কয়েক দিন শূন্যও থাকে, তাতে কোনো অসুবিধা দেখছেন না সাবেকরা।
তারা বলছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত জরুরি কোনো বিষয় না থাকলে এ শূন্যতা কোনো ধরনের ব্যঘাত ঘটাবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ কয়েকদিন খালি থাকার নজির আগেও আছে, সে কথাও তারা তুলে ধরেছেন।
‘বাধা নেই, তবে শূন্য না রাখা ভালো’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই কমিশন গঠন করতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা সংবিধানে নেই।
২০১২ থেকে ২০১৭ মেয়াদের নির্বাচন কমিশনার মো. আবদুল মোবারক বলেন, “ইসি শূন্য থাকলে (সাংবিধানিক) কোনো অসুবিধা নেই। জরুরি কোনো নির্বাচনও নেই এখন। মাঝে মাঝে কমিশনে গ্যাপ হয়েছে কমিশনে।
“ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ পর্যন্ত সময় রয়েছে। এসময়ে নতুন কমিশন করে নিতে পারবে। এর পরে করলেও আইনগত কোনো অসুবিধা নেই, কিছুদিন সিইসির পদ শূন্য থাকলেও সমস্যা নেই।”
তার যুক্তি, “কমিশন শূন্য থাকলেও কোনো অসুবিধা হবে না, কারণ কোনো নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে না। নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।”
বর্তমান সার্চ কমিটির সদস্য মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ২০০৭ থেকে ২০১২ মেয়াদে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওই কমিশন যোগ দেওয়ার আগে দুই সপ্তাহ সিইসি পদ শূন্য ছিল।
জানতে চাইলে সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “এখন এটা এতো জরুরি না, সাংবিধানিক কোনো ঝামেলা নেই। তবে শূন্য না রাখাটা ভালো।“
তিনি বলেন, “এসব নিয়েও আলোচনা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে করে ফেলা যায়, যদিও গেজেটে ১৫ দিন সময় রয়েছে।…সার্চ কমিটির একটি বৈঠক হলে সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতামত জানতে কয়েক দফা ফোন করা হয়। তবে কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
২০০৬ সালে বিচারপতি এম এ আজিজ কমিশনের সময়ে সর্বোচ্চ ছয় সদস্যের কমিশন ছিল; সবার পদত্যাগের মধ্যে সপ্তাহ খানেক শূন্য ছিল এসব পদ।
বহুল আলোচিত ২২ জানুয়ারি ভোটের আগের দিন পদত্যাগ করেন বিচারপতি আজিজ। জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সিইসি হন। পরে পাঁচ সদস্যই ৩১ জানুয়ারি একযোগে পদ ছাড়েন।
এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ দিন পর এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি নিয়োগ পায় ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সালে। তার সঙ্গে নিয়োগ পেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন। এ কমিশনের আরেক সদস্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন যোগ দেন ১৪ ফেব্রুয়ারি।
পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দুজনের মেয়াদ শেষ হয়। আরেকজন নির্বাচন কমিশনার তখন বহাল থাকায় শূন্য থাকেনি ইসি। এরপর এম সাখাওয়াত হোসেন পাঁচ বছর কাল পার করে বিদায় নেন ১৪ ফেব্রুয়ারি।
সিইসি | মেয়াদকাল |
কে এম নূরুল হুদা | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ |
কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ | ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ |
ড. এ,টি,এম শামসুল হুদা | ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি |
বিচারপতি এম.এ. আজিজ | ২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭ |
এম এ সাইদ | ২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫ |
জনাব মোহাম্মদ আবু হেনা | ৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০ |
বিচারপতি এ.কে.এম সাদেক | ২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬ |
বিচারপতি মোঃ আব্দুর রউফ | ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫ |
বিচারপতি সুলতান হোসেন খান | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ |
বিচারপতি চৌধুরী এ.টি.এম. মাসুদ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ |
বিচারপতি এ.কে.এম. নুরুল ইসলাম | ৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ |
বিচারপতি মো. ইদ্রিস | ৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭ |
এরপরের কমিশনগুলোতে একযোগে ইসি শূন্য থাকেনি। তবে ২০১২-২০১৭ মেয়াদের ইসিতে ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিইসিসহ চার জন্য বিদায় নেন, পাঁচ সদস্যের আরেকজন মেয়াদ শেষ করেন ১৪ ফেব্রুয়ারি।
এক্ষেত্রে পাঁচ দিনের জন্য এক নির্বাচন কমিশনারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো কাজই ছিল না।
এরইমধ্যে সংলাপ-সার্চ কমিটি পেরিয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের ইসি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
সবাই এক দিনেই কমিশনে যোগ দেন তারা; যাদের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার।
এ পর্যন্ত ১২ জন সিইসি ও ২৭ জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন।
শনিবার গঠিত সার্চ কমিটি একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজন নির্বাচন কমিশনারের মোট পাঁচটি পদের জন্য দুজন করে ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। তাদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে রাষ্ট্রপতি গঠন করবেন ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন। তাদের ওপরই থাকবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ভার।
আরও পড়ুন: