জীবনের মোড় ঘোরাতে ঋণ নিয়ে বাসের মালিক হওয়া আবুল কাশেম আরও একটু স্বচ্ছলতার আশায় সদরঘাট থেকে চন্দ্রা রুটে নিজেই চালাতেন সেই বাস; যেটির মধ্যেই নিভে গেল তার ‘জীবন প্রদীপ’।
Published : 28 Jun 2021, 08:03 PM
৪৫ বছর বয়সী এই চালক বাস কিনতে ঋণ করেছিলেন ১২ লাখ টাকা। তার কেনা বাসটি নিজেই চালাতেন আজমেরি পরিবহনের পরিচালনায় সদরঘাট থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা রুটে।
রোববার সন্ধ্যাতেও এই রুটেই নিজের বাসে চালকের আসনে ছিলেন তিনি। মগবাজার ওয়্যারলেস পৌঁছার পরই ঘটে সেই ভয়াল দুর্ঘটনা, যেটির নির্মম শিকার হন মাঝবয়সী কাশেম।
বিকট বিস্ফোরণে ধসে পড়া তিন তলা ভবনের কাঁচ ও ক্রংকিটের বড় বড় টুকরোর আঘাতে তার পরিবারের জীবিকার প্রধান ভরসা বাসটিও এবড়োথেবড়ো হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পরপরই মারা যান এই বাস চালক।
ব্যস্ততম মগবাজারের এই সড়কে রোববার সন্ধ্যায় এই ভয়াল বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে আরও একটি বাস ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন পর্যন্ত ধারণা অনুযায়ী জমে থাকা গ্যাসে তিন তলা ওই ভবন ধস এবং আশেপাশের ভবনের কাঁচ ভেঙেচুরে নিচে পড়ার এই ঘটনায় নিহত হন সাত জন। আহতের সংখ্যা চার শতাধিক।
এই নিহতদেরই একজন বাস চালক আবুল কাসেম, ব্যস্ততম সপ্তাহ শেষে যার গাজীপুরে পরিবারের কাছে ফেরার কথা ছিল। তার ছোট্ট মেয়ে মিমও আশায় ছিল বাবা ফিরবেন চানাচুর ও চকলেট নিয়ে, যা তার কাছে ‘মজা’ হিসেবেই পরিচিত।
সোমবার সকালে তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে মিম আক্তার রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের এক কোণে বসে কাঁদছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বলে, “চারদিন আগে গাজীপুরের সালনার বাসা থেকে বাবা ঢাকায় আসেন। আর তিনদিন পরই ফেরার কথা ছিল।
“আমি তো ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম, বাবাকে ছাড়া কেমনে হব,” কান্নার সুরে বলে চলে মিম।
কাশেমের স্ত্রী সোহাগী বেগমও স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। কোনো কথাই যেন বলতে পারছিলেন না। হাসপাতালে এসেছেন মরদেহ নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে।
“কাশেম আমাদের মা-মেয়েকে ভালো রাখার জন্য ১২ লাখ টাকা ঋণ করে বাসটির মালিক হয়েছিল।
“এখন কীভাবে কী হবে”, বারবার বিলাপ করে একই কথা বলছিলেন সোহাগী।
মেয়ের জন্য চিকিৎসকের সিরিয়াল নিতে এসেছিলেন স্বপন
বার্ন ইউনিটে মারা যাওয়ার তালিকায় রয়েছেন মো. স্বপন (৩৫) নামের এক ব্যক্তিও।
স্বপনের বৃদ্ধ বাবা নুর ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বপ্না নামে স্বপনের এক মাস বয়সী মেয়ে রয়েছে। সেই মেয়ের জন্য একজন শিশু চিকিৎসকের সিরিয়াল নিতে ওই ভবনের কাছে এসেছিল।
ধরা গলায় তিনি বলেন, “সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বপন মগবাজারে 'অগ্রণী ট্রেডিংয়ে' চাকরি করত। এখন যে কী হবে সবার।“
ওই কন্যা সন্তান ছাড়াও বিশাল ও সিজান নামে দুই ছেলে রয়েছে স্বপনের। স্ত্রীর নাম মুন্নি বেগম।
বার্ন ইউনিটে মারা যান মোস্তাফিজুর রহমান (২৭)। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ, থাকতেন শনির আখড়ায়।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, এখনও পাঁচজন ভর্তি রয়েছেন সেখানে। তাদেরকে মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, যাদের শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
তারা হলেন- নুরুন্নবী (৩৫), ইমরান হোসেন (২৫) ও রাসেল (২১)।
নুরুন্নবীর স্ত্রী পপি বেগম জানান, ভ্যান চালিয়ে বাড্ডা থেকে ফেরার পথেই এই দুর্ঘটনায় পড়েন তার স্বামী।
ইমরান ও রাসেল বেঙ্গল মিটসে চাকরি করতেন। দুঘর্টনার সময় তিন ভবনের নিচে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের শোরুমে ছিলেন তারা।
বার্ন ইউনিটের সাধারণ বেডে ভর্তি রয়েছেন জাফর (৬১) ও কালু (৩৩) নামে দুইজন।
আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, জাফর ও কালুর অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়।
অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এসএম কামাল হোসেন (৪২), সুভাষ (৩২), শামীম (৩০) ও হৃদয় (২৭)।
কামালের স্ত্রী সানোয়ারা খান সানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার স্বামী আগে গফরগাঁওয়ে একটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। এখন উত্তর শাহজাহানপুরে থাকেন এবং একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক।
হৃদয় জানান, ঘটনার সময় তিনি ফ্লাইওভারের একটি বাসে ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, কামালের মাথায় ও হাতে জখম রয়েছে। হৃদয়ের কোমরে ক্ষত রয়েছে। বাকি দুজন ভালো আছেন।
সোমবার সকালে ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম নিহতের স্বজনদের হাতে ২০ হাজার টাকা তুলে দেন।
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস গেইট এলাকা কেঁপে ওঠে।
বিস্ফোরণের ধাক্কায় আড়ং, বিশাল সেন্টারসহ আশপাশের ডজনখানেক ভবনের কাচ ভেঙে পড়ে।
পরে দেখা যায়, আড়ংয়ের উল্টো দিকে আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিনতলা ভবনটির প্রায় ধসে পড়ে।
ওই ভবনের দোতলায় সিঙ্গারের বিক্রয় কেন্দ্র ছিল। নিচতলায় খাবারের দোকান শরমা হাউজ ও বেঙ্গল মিটের বিক্রয় কেন্দ্র ছিল, যা মিশে গেছে। লোহার গ্রিল, আসবাবপত্র, ভবনের বিভিন্ন অংশ ছিটকে এসেছে রাস্তায়।
সড়কের উপর আটকে থাকা দুটি ক্ষতিগ্রস্ত বাসের ভেতরে যাত্রীদের রক্ত আর জিনসপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন