তিনি বললেন, “সত্যিই আমি কী করব বুঝে উঠতে পারিনি। হুড়াহুড়ি করে নিচে নামার সময় কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো শব্দে আমার ব্রেইনও কাজ করছিল না। তবে সেন্স ছিল। নিচে নেমে দেখলাম, অবিরামভাবে উপর থেকে কাচের বড় বড় টুকরো ভেঙে পড়ছে। বড় বড় সব ইট-পাথর ও কাচের টুকরো ডিঙিয়ে কোনোমতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।”
রোববার সন্ধ্যার পর ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস গেইটে ভয়াবহ বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই বিবরণ দেন তিনি।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সুলায়মান চৌধুরী থাকেন সিদ্ধেশ্বরীতে। সন্ধ্যায় আড়ংয়ে গিয়েছিলেন ছোট মেয়ের জন্য জামা কিনতে। কেনাকাটা শেষ করে বের হওয়ার সময় সাড়ে ৭টার দিকে বিস্ফোরণটি ঘটে।
সুলায়মান বলেন, “দৌড়াতে দৌড়াতে নিরাপদ স্থানে এসে যখন ক্লান্ত শরীরে দাঁড়ালাম, তখন বুঝলাম আমি বেঁচে আছি। বাসায় গিয়ে মনে পড়ল আমার মোবাইলটাও কোথায় যে ফেলে এসেছি।”
ঠিক তখন সেই আড়ংয়ে ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা মাহসুমা সাফতা।
তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “৭:৩০ এর দিকে বিস্ফোরণ। মাথা কাজ করছিল না, মনে হলো টেররিস্ট এটাক হলে আটকা পড়তে পারি বা আবার এটাক হতে পারে।
“আমি কি মেয়ের কাছে ফিরতে পারব আর! আড়ংয়ে ছিলাম, বের হতে পারলাম। আচরণ এবনরমাল ছিল। রক্ত আর ধ্বংসস্তূপ পার হয়ে কোনোমতে রিকশায় উঠে সামীউলকে ফোন দিলাম।”
“বাসায় এসে টিভি চালাই। আস্তে আস্তে খবর আসে। বেঁচে আছি। মিরাকল! আহত হই নাই। তবে ট্রমা কাটাতে পারব কি না জানিনা।”
মগবাজার ওয়্যারলেইস গেইটে সড়কের যে পাশে আড়ং, তার বিপরীত পাশের একটি তিনতলা ভবনই এই বিস্ফোরণের কেন্দ্র বলে ধারণা কর হচ্ছে।
তিনতলা ওই ভবনটির বিস্ফোরণ এতটাই ভয়ানক ছিল যে আশপাশের ডজনখানেক ভবন এমনকি সড়ক-ফ্লাইওভারের ওপারে থাকা আড়ং, বিশাল সেন্টারের কাচ চৌচির হয়ে নিচে পড়ে যায়। সড়কে থাকা দুটি বাসের সবগুলো কাচ ভেঙে পড়ে।
ভবনটির একাংশ গুঁড়িয়ে গেছে। ওই ভবনের দোতলায় ছিল সিঙ্গারের বিক্রয় কেন্দ্র। নিচতলায় ছিল খাবারের দোকান শরমা হাউজ, বেঙ্গল মিটের দোকান।
যে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ঠিক তার পেছনের ভবন থাকেন ওরিয়েন্টাল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ শেখ আদুল জলিল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েনিটফোর ডটকমকে জানান, “পুরো ভবন কেঁপে উঠল। ঘরের জানালা দরজার কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মনে হল যেন ভয়াবহ ভূমিকম্প।
“দ্রুত নেমে এসে দেখি পাশের ভবনের ওপর থেকে কাচ ভেঙে পড়ছে। চারদিকে ধুলো দিয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে, ভবনটি ঢেকে গেছে।”
একই ভবনের নিচতলায় থাকেন মৈত্রী নার্সিং হোমের মালিক রফিকুল ইসলাম। তিনি ঘটনার সময় নিজ কক্ষে বসে ছিলেন।
তিনি বলেন, “এমন ভয়াবহ দৃশ্য জীবনে দেখিনি। বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। পুরো ভবন কেঁপে উঠল। আমার কক্ষের যত কাচ ছিল সব চুরমার হয়ে নিচে পড়ছে। ছুটে বাইরে এসে একটু এগিয়ে দেখি আরও ভয়াবহ দৃশ্য। কারও হাত ঝুলছে, কারও পা রক্তে রক্তাক্ত।”
রফিকুল জানান, যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই ভবনের সামনে মাটি কেটে পাইপ বসানোর কাজ চলছিল। সেখানে কাদা পানিতে ভর্তি। সেখানে ৭/৮ জনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেন তিনি।
ভবনের নিচতলায় শরমা হাউজে এক নারীকে তার শিশু কন্যা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রক্তাক্ত থাকতে দেখেন রফিকুল। পরে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ভবনের নামনের ফ্লাইওভারের নিচে থাকেন ভাসমান কয়েকজন। তাদের একজন রমজান আলী বলেন, বিকট শব্দে প্রথমে ভয় পেয়ে যাই। মনে হয় ফ্লাইওভারটি ভেঙে পড়েছে। পরে বুঝতে পেরে দৌড়ে ভবনের কাছে গিয়ে দেখি ভয়াবহ দৃশ্য।
সড়ক পেরিয়ে ওই ভবনের ঠিক বিপরীতে রাশমনো হাসপাতাল। এই হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক সাদিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সেবা দেওয়ার কোনো পরিস্থিতি ছিল না। বিস্ফোরণের পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের প্রায় সব কাচ ভেঙে পড়ে।”
রাশমনো হাসপাতালের পাশের আড়ংয়ের ভবনের সবগুলো কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
রিকশাচালক মোমিন আলী ওয়্যারলেস রেলগেটের অভিমুখে যাওয়ার সময়ে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান।
তিনি বলেন, “স্যার আমি দুইজন যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময়ে ডুরম ডুরম শব্দ। শব্দ শুইনা প্রথমে আমার মনে হইছে কোনো জঙ্গি সন্ত্রাসীর দল অ্যাটাক করছে।
“আমার রিকশার দুই যাত্রী দৌড়িয়ে চলে গেল। আমি রিকশাটা কোনোমতে সাইড করতে পারছিলাম।”
আদ-দ্বীন হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়ার পথে ফারজানা মুহিত মগবাজারের কাছেই ছিলেন ঘটনার সময়ে।
তিনি বলেন, “আমাদের গাড়িটা জ্যামের ভেতরে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটনার পর আমার গাড়ি বেহাল হয়ে গেছে। কোনো রকমে গাড়ি থেকে দ্রুত বের হওয়াতে রক্ষা পেয়েছি। নইলে যেভাবে উপর থেকে ধ্বংসস্তূপ পড়ছিল, তাতে নির্ঘাত মৃত্যু সামনেই ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বেঁচে গেছি।”
তিনি জানান, বেঁচে গেলেও তার মাথা ঝিন ঝিন করছে। আদ-দ্বীন হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা বিশ্রামে থাকতে বলেছেন।
আলিম নামের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, “ওয়্যারলেস জামে মসজিদে নামাজ পড়ে এখানে আমার প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে বসেছিলাম, ১০ থেকে ১৫ মিনিট। এর ভেতরেই বিকট শব্দ, বোমাকেও হার মানাবে, খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। ওই মুহূর্তে আমি বের হলাম, এসে দেখলাম, চারদিকে বিল্ডিংয়ের কাচ, বাস ভেঙে একাকার।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে, তার মালিকের নাম খোকন।
ঘটনার পর মগবাজার ওয়্যারলেস একটি এপার্টমেন্টের কয়েক বাসিন্দা নিচে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাদের একজন মুফাকর উল ইসলাম বলেন, “আমরা এখান থেকে অনেকটাই দূরে। তারপরও আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে বেশ কয়েকটি জানালার গ্লাস ভেঙে গেছে।”
কেমন করে এটা হল- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “বিকট শব্দে। দেখবেন, এই এলাকার মানুষজনের অনেকেরই কানে সমস্যা দেখা দেবে। আমি নিজেরও কেমন কেমন যেন লাগছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে সকলে ভয় পেয়েছে, বাচ্চারা তো একেবারে চুপসে গেছে।”
ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, কোনো গ্যাস জমে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে তদন্তের পরই তা স্পষ্ট হওয়া যাবে।
মুফাখর বলেন, “এই ঘটনার একটা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত।”
তিনি জানান, ঘটনার পর নারী-পুরুষ অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি করার সময় উপর থেকে পড়া ভাঙা কাচে আহত হয়েছেন। বাসযাত্রীরাও আহত হন।
এই বিস্ফোরণে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক।