ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুন লেগে কোভিড-১৯ ইউনিটের পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়ার যে আদেশ হাই কোর্ট দিয়েছিল, তা স্থগিত হয়ে গেছে।
Published : 17 Jan 2021, 04:29 PM
রোববার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানির পর আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারক মো. নূরুজ্জামান আট সপ্তাহের জন্য হাই কোর্টের আদেশ স্থাগতি করে দেন।
এ আদালতে ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান। রিটকারী পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী অনীক আর হক, হাসান এম এস আজিম, মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ, নিয়াজ মোহাম্মদ মাহবুব ও শাহিদা সুলতানা শীলা ও রাকিব হাসান।
পরে মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হাই কোর্ট কদিন আগে যে আদেশ দিয়েছিল, তার কার্যকারিতা আপাতত আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন চেম্বার আদালত।”
ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী যুক্তিতে হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়েছে জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, “ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নে হাই কোর্ট তো একটি রুল জারি করেছেন, যে রুলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে- কেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১৫ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না।
“আমাদের মূল কথা হচ্ছে, যেহেতু রুল জারি হয়েছে, এর চূড়ান্ত শুনানির পর একটি সিদ্ধান্ত হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না রুলের পূর্ণাঙ্গ শুনানি হচ্ছে, তার আগেই আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হল, তাহলে তো পক্ষান্তরে তো রুলটিই যথাযথ হয়ে গেল।”
মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, “এটা জনস্বার্থের কোনো মামলা না। যারা আবেদনকারী তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য। প্রশ্ন হচ্ছে, একটা বেসরকারি পক্ষ আরেকটি বেসরকারি পক্ষের বিরুদ্ধে রিট করার এখতিয়ার রাখে কিনা। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য আছে।
“তাছাড়া এ ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ইউনাইটেড হাসপাতালের দায় আছে কিনা সেটা সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয়। রিটে এই বিষয়টির নিরসন সম্ভব না। তার জন্য নিম্ন আদালতে মামলা করতে হবে। ফ্যাটাল অ্যাকসিডেন্ট অ্যাক্ট ১৮৫৫ অনুযায়ী দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু যদি হয়, তাহলে সেই মৃত্যুতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা ক্ষতিপূরণের মামলা অবশ্যই করতে পারবেন। তার জন্য নিম্ন আদালতে দেওয়ানী মামলা করতে হবে।”
হাই কোর্টের আদেশের অনুলিপি পেলে নিয়মিত লিভ টু আপিল করা হবে বলেও জানান ইউনাইটেড হাসপাতালের আইনজীবী।
প্রেক্ষাপট
গত বছরের ২৭ মে রাতে গুলশানের বেসরকারি ওই হাসপাতালের প্রাঙ্গণে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য করা আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লেগে পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে তিনজনের কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিল।
ওই পাঁচজন হলেন- মো. মাহবুব (৫০), মো. মনির হোসেন (৭৫), ভারনন অ্যান্থনি পল (৭৪), খোদেজা বেগম (৭০) ও রিয়াজ উল আলম (৪৫)।
ওই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন এবং নিহতদের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত ৩০ মে একটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিয়াজ মাহবুব ও শাহিদা শিলা।
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মাহবুব এলাহী চৌধুরীর ছেলে আননান চৌধুরী এবং ভারনন অ্যান্থনি পলের ছেলে আন্দ্রে ডোমিনিক পলও পরে সে রিট আবেদনে অন্তর্ভুক্ত হন।
এরপর নিহত রিয়াজুল আলমের স্ত্রী ফৌজিয়া আক্তার ১৫ কোটি ক্ষতিপূরণ চেয়ে আলাদা একটি রিট আবেদন করেন। তাতে এক কোটি টাকা অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়।
তার আগে এ ঘটনার বিচারিক তদন্ত চেয়ে গত বছর ১ জুন আরও দুটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী রেদওয়ান আহমেদ ও হামিদুল মিসবাহ।
এরপর ২ জুন এসব আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ১৪ জুনের মধ্যে ঘটনার প্রতিবেদন দিতে বলে হাই কোর্ট।
এর মধ্যে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে ইউনাইটেড হাসপাতালের গাফিলতির কথা আসে।
রাজউক জানায়, কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য আলাদা করে আইসেলেশন ইউনিট করার অনুমতি নেয়নি ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নিলে রোগীদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হত। তাছাড়া হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।
অন্যদিকে ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনাকে ‘স্রেফ দুর্ঘটনা’ বলা হয়।
ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত বছর ২৯ জুন এক আদেশে হাই কোর্ট ইউনাইটেড হাসপাতালকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করতে বলে।
সেই সঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে করা মামলাটির তদন্তও দ্রুত শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইউনাইটেড হাসাপাতালের আইনজীবী মোস্তাফিজুর তখন বলেছিলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তারা ক্ষতিগ্রস্ত সবার পরিবারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে অর্থ দিতে চেয়েছিল, তাতে রাজি হয়নি চার পরিবার। অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া মনির হোসেনের পরিবার শুধু ২০ লাখ টাকায় সমঝোতায় সম্মত হয়।
পরে ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমঝোতায় আসতে না পারার বিষয়টি হাই কোর্টকে জানানো হলে ওই বছর ১৫ জুলাই হাই কোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে নির্দেশ দেয়।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। একক বেঞ্চ হওয়ায় আদালত সেদিন রুল জারি থেকে বিরত থাকে।
পরে হাই কোর্টের সে আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
গত বছর ২১ জুলাই চেম্বার আদালত হাই কোর্টের আদেশটির কার্যকারিতা স্থগিত করে দেয় এবং ইউনাইটেডের আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য রাখে।
পরে গত বছর ২০ আগস্ট রিট আবেদনগুলো নতুন করে হাই কোর্টের রিট বেঞ্চে উপস্থাপন করতে বলে আপিল বিভাগ।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ, বিচারিক তদন্ত চেয়ে করা তিনটি রিট আবেদন বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চে উপস্থাপন করা হলে গত ১১ জানুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেয়।
সে আদেশে ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া আগুনে মারা যাওয়া চার রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে ১৫ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, সেই সঙ্গে হাসপাতালে রোগীদের অধিকার রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং অবহেলার দায়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের অনুমতি কেন বাতিল করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশটি স্থগিত চেয়ে আবেদন করে হাইনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সে আবেদনের শুনানির পর রোববার চেম্বার আদালত হাই কোর্টের আদেশের এ অংশটি স্থগিত করে দিল।
আরও খবর-