মহামারীতে আটকা পড়া কী পরিমাণ আগ্রীম টিকেটের যাত্রীকে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে পৌঁছে দিতে হবে, তার সঠিক হিসাব নেই সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের ঢাকা অফিসে।
Published : 05 Oct 2020, 01:14 PM
অন্যদিকে গত ২০ দিন ধরে হাজার হাজার সৌদি প্রবাসী ওই বিমান পরিবহন সংস্থার কার্যালয়ের সামনে দিন-রাত অপেক্ষা করে চলেছেন, যারা গত মার্চ মাসে ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আগেই ফিরতি টিকেট কিনে রেখেছিলেন।
পুরোনো টিকেট নবায়নের ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্সটির ঘোষণায় অস্পষ্টতা এবং বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দুর্ভোগকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
প্রতিদিন নতুন নুতন জটিলতার সৃষ্টি হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না সাউদিয়ার এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সীমিত পরিসরে ফ্লাইট চালু করে সৌদি আরবের এই এয়ারলাইন্স। তার এক সপ্তাহ আগে থেকেই আগাম টিকেটের যাত্রীরা তাদের টিকেট হালনাগাদ করার জন্য এয়ারলাইন্সে কার্যালয়ে ভিড় করতে শুরু করেন।
এর বাইরেও নতুন করে ২৫ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরবে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু আগে থেকে বুকিং দেওয়া যাত্রীদেরই আপাতত টিকেট দেওয়া হচ্ছে।
গত ২০ দিন ধরেই টিকেট প্রত্যাশীরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সাউদিয়ার কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নিয়ে আছেন সমস্যা সমাধানের আশায়। কখনও কখনও ভিড় বেড়ে গিয়ে হাজারো মানুষের জমায়েত হয়ে যাচ্ছে। তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও দেখাচ্ছেন। কিন্তু সমাধান হচ্ছে খুবই ধীরে।
কেন এত লোক সমাগম?
গত রোববার নতুন করে টোকেন দেওয়ার ঘোষণায় প্রায় ১০ হাজার টিকেট প্রত্যাশী জড়ো হয়েছিলেন সোনারগাঁও হোটেলের দুইপাশে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কয়েকশ মানুষকে টোকেন দেওয়ার পর বেলা ১১টার দিকে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। দিনের বাকি অংশ বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই কেটেছে।
কর্তৃপক্ষের ঘোষণা ছিল, যাদের বৈধ ভিসা, আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) ও এয়ারলাইন্সের অগ্রিম টিকেট রয়েছে, তাদেরকে নতুন টিকেট কবে দেওয়া হবে, সেই টোকেন দেওয়া হবে রোববার। সেই টোকেন নিয়ে নির্ধারিত দিনে এলে তারা টিকেট পাবেন।
পুরো বিষয়টি ব্যবস্থাপনার জন্য মাত্র সাতজন লোক রয়েছে সাউদিয়ার সোনারগাঁও কার্যালয়ে।
কত যাত্রীকে টিকেট নবায়নের সুযোগ দিতে হবে জানতে চাইলে এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশ অফিসের সেলস ম্যানেজার ওমর খইয়াম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই হিসাব বাংলাদেশে বসে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তারা টিকেট কেটে এসেছে সৌদি আরব থেকে। তাই আমরা বলতে পারবো না, কী পরিমাণ যাত্রীকে টিকেট নবায়ন করে দিতে হতে পারে।”
রোববার টিকেটের জন্য প্রায় ১০ হাজার মানুষ চলে এসেছিল বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা। এরকম জন সমাগমের বিষয়টি ছিল তাদের ‘ধারণার বাইরে’।
“এত মানুষ চলে আসবে আমরা বুঝতে পারিনি। তাই এক পর্যায়ে আর টোকেন দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা দুপুরের দিকে নতুন একটি ফর্ম ছেড়েছি। সেখানে যাত্রীর নাম, ভিসার মেয়াদ, পুরোনো টিকেটের নম্বর ও ফোন নম্বর নিয়ে রাখা হচ্ছে। যাদের ভিসার মেয়াদ অচিরেই শেষ হচ্ছে, তাদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে টিকেট ইস্যু করা হবে,” বলেন খইয়াম।
তিনি অভিযোগ করেন, ভিসার মেয়াদ না থাকার পরও অনেকে চলে আসছেন টিকেটের জন্য। সে কারণেই লোক সমাগম বেড়ে গেছে।
‘হয়রানি ছাড়া কিছুই হচ্ছে না’
তিনি বলেন, “খবরে শুনছিলাম আজকে টোকেন দেবে। কিন্তু এখনও কিছুই দেখছি না। আজ প্রায় ১০ দিন ধরে এখানে আসছি আর যাচ্ছি। কিন্তু কীভাবে কী হবে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
বিক্ষোভরত আরেকজন বলেন, অক্টোবরের ৩০ তারিখে তার ভিসার মেয়াদ শেষ। ১০/১২ দিন ধরে তিনি নিয়মিত এয়ারলাইন্সের অফিসে আসছেন। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে এসে বসে থাকছেন। রাত হলে চলে যাচ্ছেন।
“কিন্তু সঠিক কোনো তথ্য পাচ্ছি না, কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। আমার তো টিকেট হাতে পাওয়া ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনো কাজ নেই।”
রবিউল হাসান নামে ময়মনসিংহ থেকে আসা একজন বললেন, “ক্ষেত বন্ধক দিয়া দুই লাখ টাকা খরচ কইরা আকামা লাগাইছি, ছুটি বাড়াইছি। আমি যদি না যাইতে পারি আমার সব শেষ। সৌদিতে ফার্নিচারের দোকানে আমার লাখ লাখ টাকার বিনিয়োগ অন্যের পেটে যাবে। আমাদের দুঃখ বড়দের কানে পৌঁছাবে না। আমরা মরছি তো মরছিওই।”
ফরিদপুর থেকে আসা সাঈদ উদ্দিন রোববার মিলিয়ে মোট চারদিন কারওয়ান বাজারে সৌদি এয়ারলাইন্সের কার্যালয়ে এসে ফেরত গেলেন। কিন্তু সৌদি আরবে ফিরতি যাত্রার বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি তিনি।
সাঈদ বলেন, দেড় লাখ টাকা খরচ করে আকামা ও ভিসির মেয়াদ তিনি বাড়িয়েছেন। গত নভেম্বরে বাড়ি আসার পর সব মিলিয়ে দুই দফায় ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে। ২২ নভেম্বর সেটারও মেয়াদ শেষ । তিনি চান তার আগেই যত দ্রুত সম্ভব সৌদি আরবে যেতে।
“তারা যদি বিভাগ ধরে ধরে টিকেট দিতে তাহলেও এত গণ্ডগোল হত না। অথবা দুই চারটা জেলার নাম ধরে ধরে বললেও এতো মানুষ এখানে ভিড় করতে আসত না। কোনো দিকে তারা কোনো শৃঙ্খলা করে নাই। মানুষকে হয়রানি করা ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না এখানে।”
তথ্য দেবেন কে?
টিকেট প্রত্যাশীদের এই দুর্ভোগ নিয়ে সাউদিয়া কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। ফলে কী কৌশলে তারা সমাধান করতে চান তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গত শুক্রবার সাউদিয়ার কাউন্টার ম্যানেজার জাহিদ হোসেনের কক্ষে গেলে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি।
“ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। আমার কথা বলার অনুমতি নেই,” তার সাফ জবাব।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন, সেই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার কাজ আগাবে না।”
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সামনে আসেন কান্ট্রি সেলস ম্যানেজার ওমর খইয়াম। কিন্তু তিনি বলেন সেই কাউন্টার ম্যানেজারের কথা।
“এই শাখা থেকে টিকেট বিক্রির যাবতীয় তথ্য রয়েছে কাউন্টার ম্যানেজার জাহিদ সাবেহের কাছে। তিনি বলতে পারবেন প্রতিদিন কতগুলো টিকেট বিতরণ করা হচ্ছে কিংবা কতগুলো টোকেন দেওয়া হচ্ছে। পরের দিন কীভাবে কাজ চলবে তাও তিনি জানেন।”
বৈধ পথে টিকেট না মিললেও বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ২০/৩০ হাজার টাকা বেশি দিলে সাউদিয়ার টিকেট নবায়ন এবং লাখ টাকায় নতুন টিকেট পাওয়া যাচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ওমর বলেন, “আমরা আপাতত কোনো নতুন টিকেট ইস্যু করছি না। পুরোনো যাত্রীদেরকেই বিনামূল্যে পার করা হচ্ছে।”
টিকেট যেখানে আগেই কেনা, তাহলে ‘বিনামূল্যে’ কেন বলছেন- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এগুলো নিয়মিত ফ্লাইট নয়। বিশেষ ফ্লাইটের মাধ্যমে যাত্রী পার করা হচ্ছে।”