কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিস) ইউনিটের একটি দল গত ৭ এপ্রিল ভোরে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে দণ্ডিত এই আসামিকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। সেদিন দুপুরে তাকে আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল কারাগারে।
সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে পাঁচ দিন পর রোববার প্রথম প্রহরে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাজেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
পলাতক থাকায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তার ছিল না। একটা সুযোগ ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া, সেটা তিনি করেছিলেন এবং তা খারিজ হয়ে যায়। এরপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি শুরুর পর স্ত্রীসহ স্বজনরা তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সুযোগ পান।
দেশে নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন শুরুর পর যখন তা বাস্তবায়নে মাঠে পুলিশ তৎপর, তখন অনেকটা অনায়াসেই গ্রেপ্তার করা হয় মাজেদকে।
তাকে যখন আদালতে নেওয়া হয়, তখন আদালতপাড়া ফাঁকা। খুব জরুরি মামলা ছাড়া আদালতও বসছে না এখন।
মাজেদকে যখন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হল, তখন আদালত প্রাঙ্গণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদকর্মী ছাড়া মানুষ ছিল সামান্যই।
ঢাকা কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, “অন্য সময় হলে ভিড় সামাল দিতে অনেক কষ্ট হত। আজ সেই ঝামেলা হয়নি। তারপরও কিছু উৎসুক মানুষ এসেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদকে দেখতে।”
আবদুল মাজেদের বাবার নাম আলী মিয়া চৌধুরী, মায়ের নাম মেহেরজান বেগম, বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনের কালীগঞ্জের বাটমারায়।
মাজেদের স্ত্রী সালেহা বেগম, চার মেয়ে ও এক ছেলে ঢাকা সেনানিবাসের এক নম্বর রোডের একটি বাসায় বসবাস করছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন মাজেদ। তখন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেনি, সে জেলহত্যায় অংশগ্রহণ করেছে বলে আমাদের জানা রয়েছে। খুনের পরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক সে বঙ্গভবন ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করেছে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাজেদ কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। অন্য খুনিদের সঙ্গে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ ছিল তার।
পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান মাজেদ। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই তারা সে সময় নিরাপদে দেশ ছেড়ে যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
মাজেদরা লিবিয়ায় ছিলেন তিন মাস। এরপর ‘পুরস্কার হিসেবে’ তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাজেদকে পাঠানো হয় সেনেগাল দূতাবাসে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ আবদুল মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিবের মর্যাদায় তিনি বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন।
পরে তাকে তখনকার যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক করা হয়। এরপর দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিচারের পথ খোলে। মামলার পর বিচারও শুরু হয়। সে সময় আটক হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে যান আবদুল মাজেদ।
এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে ফের শ্লথ হয়ে যায় মামলার গতি। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়।
সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া আসামিদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি) ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি।
কিন্তু খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খানের মতো আবদুল মাজেদও পলাতক ছিলেন।
এতদিন কোথায় পালিয়ে ছিলেন মাজেদ?
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই দশকের বেশি সময় ভারতে আত্মগোপনে ছিলেন মাজেদ। সেখানে তিনি থাকতেন কলকাতায়। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশে ফেরেন।
তবে কীভাবে তিনি দেশে ফিরলেন এবং এরপর গত প্রায় তিন সপ্তাহ কোথায় ছিলেন- তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা হাস্যরসের ছলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “করোনার ভয়ে মনে হয় চলে এসেছে বাংলাদেশে।”
পুলিশ বলছে, সূর্য উঠার আগে আগে ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে রিকশায় করে মাজেদ একাই যাচ্ছিলেন। সন্দেহ হলে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে অসংলগ্ন কথা বললেও পরে তিনি নিজের পরিচয় জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বলেও স্বীকার করেন।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক অন্য খুনিদের মতো মাজেদের নামেও ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিস জারি করা ছিল। ২০০৯ সালে এই নোটিশ জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে।
মাজেদ ফাঁসিতে ঝোলার পর এখন পলাতক রয়েছেন আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।