এত আকাঙ্ক্ষার আসামি এত সহজে ধরা!

দীর্ঘকাল পালিয়ে থাকা যে আসামিদের ধরতে দশকব্যাপী চেষ্টা করছে বাংলাদেশ, সহায়তা চাওয়া হয়েছে ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন দেশের, তাদেরই একজন গ্রেপ্তার হলেন দেশেই এবং পুলিশের ভাষ্যে অনেকটা অনায়াসেই।

লিটন হায়দার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2020, 04:44 PM
Updated : 7 April 2020, 05:40 PM

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ছয়জন পলাতক ছিলেন, তাদের একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে বুধবার ভোর রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে সারাদেশ যখন লকডাউনে এবং তা বাস্তবায়নে পুলিশ যখন তৎপর মাঠে, তখন ধরা পড়লেন এই ফাঁসির আসামি।

পুলিশ বলছে, সূর্য উঠার আগে আগে ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে রিকশায় করে একাই যাওয়ার সময় সন্দেহ হলে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে অসংলগ্ন কথা বললেও পরে তিনি নিজের পরিচয় জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বলেও স্বীকার করেন।

তবে এর আগে মাজেদকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, তাকে মিরপুর সাড়ে ১১ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাড়ে চার দশক পর গ্রেপ্তার হলেন খুনি অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ

জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায়ের পর ২০১০ সালে পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরপরেও পালিয়ে থাকা ছয় খুনির সন্ধানে বিগত বছরগুলোতে কাজ চালিয়ে আসার কথা বলে আসছে সরকার।

তাদের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করা হয়। ২০০৯ সালে এই নোটিশ জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে।

তবে তাদের মধ্যে শুধু দুজন এ এম রাশেদ চৌধুরী ও এসএইচএমবি নূর চৌধুরীর অবস্থান জানতে পেরেছিল বাংলাদেশ। রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে, নূর চৌধুরীকে ফিরে পেতে কথা হয়েছে কানাডা ও বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ে।

আবদুল মাজেদ ছাড়াও খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খানের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না বলেও কয়েক মাস আগেই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তারা।

এরমধ্যে আকস্মিক বঙ্গবন্ধুর এই খুনিদের একজন মাজেদকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় পুলিশ। তার গ্রেপ্তারকে ‘মুজিববর্ষের’ সেরা উপহার হিসেবে বর্ণনা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

গ্রেপ্তারের পর মাজেদকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তুললে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন একজন বিচারক।

মাজেদকে গ্রেপ্তার নিয়ে আদালতে পুলিশের দেওয়া এক পাতার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি নিয়মিত টহল দলের বিশেষ অভিযান চলাকালে ভোর পৌনে ৪টার দিকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে রিকশায় করে যেতে দেখা যায়। সন্দেহ হওয়ায় তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন।

“জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে নিজেকে ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ বলে পরিচয় দেয় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বলে স্বীকার করে।”

আবদুল মাজেদ তার গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানার কালীগঞ্জের বাটামারা গ্রামে বলে জানান। একইসঙ্গে তিনি বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসের আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের ১০/এ বাসার ঠিকানা দেন।

পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাজেদ তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি দীর্ঘদিন ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে ছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে পলাতক আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়।

“জিজ্ঞাসাবাদে নিজের পরিচয় এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি স্বীকার করায় তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়,” বলা হয়েছে সিটিটিসির এসআই মো. জহুরুল হকের দেওয়া প্রতিবেদনে।

তবে বিদেশে পালিয়ে থাকা এই আসামি কী করে দেশে ঢুকলেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট ভাষ্য আসেনি পুলিশের প্রতিবেদনে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল অনেকটা হাস্যরসের ছলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার ভয়ে মনে হয় চলে এসেছে বাংলাদেশে।”

৭২ বছর বয়সী মাজেদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, সে সব মামলায় গ্রেপ্তার না দেখানো পর্যন্ত তাকে জামিন না দেওয়ার অনুরোধ করেছে পুলিশ।

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, “এখন ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করার জন্য আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে এবং তা শেষ হলেই রায় কার্যকর করা হবে।”

আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সময় বহু বছর আগেই পেরিয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ আর মাজেদ পাবেন না। তবে সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ তার থাকবে।

সেই আবেদন তিনি না করলে বা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে সরকার এই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে।