কখনও স্বদেশি শিল্পীর সুরের মূর্ছনায় নাচ-গানে আনন্দ উল্লাস, কখনও ভিজ্যুয়াল পর্দায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজোদীপ্ত ভাষণে শিহরিত হয়ে রোমাঞ্চকর কয়েকটি ঘণ্টা কাটাল সারা দেশের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী।
Published : 08 Mar 2020, 12:34 AM
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) প্রতিষ্ঠান ইয়াং বাংলার তত্ত্বাবধানে জয় বাংলা কনসার্টের দর্শক সারিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার শীর্ষস্থানীয়রাও ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের প্রেক্ষাপটে এবারের জয় বাংলা কনসার্টে যোগ হয় নতুন মাত্রা। ঠিক ১০ দিন পর ঢাকায় শুরু হবে মুজিববর্ষের মূল আনুষ্ঠানিকতা। তার আগের এই আয়োজনে ব্যান্ড দলগুলোর গানের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেশ কিছু ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে সাজানো হয় পুরো কনসার্ট।
ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লার তরুণ তরুণীদের দল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণরা দল পাকিয়ে কেউবা আবার বিচ্ছিন্নভাবে এসেছিলেন কনসার্টে; তাদের সঙ্গে দূরের জেলা ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নীলফামারীসহ অনেক জেলার দর্শকদেরও দেখা গেছে তারুণ্যের এই মেলায়।
আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সিআরআই ও ইয়াং বাংলার আয়োজনে এবারের জয় বাংলা কনসার্ট বেলা দেড়টা থেকে শুরু হয়ে চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। আমন্ত্রিত অতিথিরা কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে প্রবেশ করে আর্মি স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায়। স্টেডিয়ামের বাইরেও ছিল কয়েক হাজার দর্শক স্রোতা।
গান পরিবেশনার সঙ্গে এবারের কনসার্টের মূল আকর্ষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের হলোগ্রাফিক উপস্থাপনা। এর মাধ্যমে ত্রিমাত্রিকভাবে মঞ্চে হাজির করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সেই সময়কে।
বেলা দেড়টার দিকে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় জয় বাংলা কনসার্টের ষষ্ঠ আসর। স্টেডিয়ামে আসা হাজারো তরুণ বুকে হাত রেখে কণ্ঠ মেলান জাতীয় সঙ্গীতে।
এরপর বাজানো হয় স্বাধীনতার চেতনা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার গান ‘জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো’ গানটি।
প্রথমে মঞ্চে আসে তরুণ ব্যান্ড দল ইনট্রোয়িট। তারা প্রথমে শোনায় লালন সাঁইয়ের গান ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন’।
তাদের পর সন্ধ্যা নামার আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আরও চার ব্যান্ড ‘আরেকটা রক ব্যান্ড’, ‘অ্যাডভার্ব’, ‘সিন’ ও ‘কনক্লুশন’-এর পরিবেশনায় মাতোয়ারা হয় তারুণ্য।
এরপর মঞ্চে গান নিয়ে আসে আদিবাসী তরুণীদের গড়া প্রথম ব্যান্ড এফ মাইনর। তাদের পর একে একে গান পরিবেশন করে মিনার রহমান, অ্যাভয়েড রাফা, শূন্য, ভাইকিংস, লালন, আর্বোভাইরাস, ক্রিপটিক ফেইট, নেমেসিস, ফুয়াদ অ্যান্ড ফ্রেন্ডস ও চিরকুট।
ব্র্যান্ড দলের গান পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে চলে অন্যান্য আয়োজন। সন্ধ্যা ৭টায় দিকে মূল মঞ্চে বাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের ভিডিওর রঙিন সংস্করণ। সন্ধ্যা নামার আগে থেকে শুরু হয়ে যায় আকাশে আতশবাজির ঝলকানি, যা চলে মধ্যরাতে কনসার্ট শেষ হওয়া অবধি।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় খুলে দেওয়া হয় স্টেডিয়ামের নয়টি গেইট। প্রবেশপথে অনলাইনে কাটা টিকিটের বারকোড স্ক্যান করে ভেন্যুতে প্রবেশ করতে শুরু করেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ও অন্য দর্শকরা।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার বাইরে থেকে আসা দর্শকদের সংখ্যা বোঝার চেষ্টা করেন আর্বোভাইরাস ব্যান্ডের ভোকাল। তিনি বলেন, “ঢাকার বাইরে থেকে কারা এসেছেন, তাদের হাতগুলো দেখতে চাই।” তখন বিশাল সংখ্যার দর্শক হাত উঁচু করে তার কথার জবাব দেন।
তরুণদের অনেকে আসেন একই ডিজাইনের পোশাকে; কনসার্টে আসা অনেকের গায়ে শোভা পায় জয় বাংলা কনসার্টের অফিসিয়াল টি-শার্ট।
বেলা সোয়া ২টার দিকে ‘আরেকটা রক ব্যান্ডের’ গান চলার সময় স্টেডিয়ামের এক প্রান্তে নেচে-গেয়ে হই-হুল্লোড় করতে দেখা যায় একদল তরুণকে।
কালো-রঙের একই ডিজাইনের টি-শার্ট পরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে একসঙ্গে এসেছেন এই ১৮ জন তরুণ।
তাদের একজন সৈকত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জয় বাংলা কনসার্টে আমরা প্রতিবারই আসি। এবার বন্ধুরা আগে থেকে ঠিক করেছি একই ডিজাইনের পোশাক পরে আসব। সেই প্ল্যান থেকে এভাবে এসেছি। এখন সবাই মিলে মজা করছি।”
কনসার্ট শুরুর আগে থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে এসে উপস্থিত হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাত শিক্ষার্থী।
তাদের একজন অনন্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভাগের ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে এসেছি। এ ধরনের কনসার্টে অনেক মজা হয়। আমরা শেষ পর্যন্ত উপভোগ করতে চাই।”
মিরপুর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কনসার্টে আসা তানিশা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে আসছি আজকে। আনন্দ ভাগাভাগির পাশাপাশি এক ধরনের মিলনমেলাও হয় এখানে।
”শুধু আনন্দ উপভোগ নয়, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকেও তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উপলক্ষ এটা।”
ময়মনসিংহ থেকে আসা আরিফুর রহমান সিয়াম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবছর আমরা এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করি। ছয় বারের মতো এবারও আমরা বন্ধুরা মিলে এসেছি। এবার আমরা এসেছি সাতজন।”
কনসার্ট শুরুর কিছু সময় পর বিকালে সিআরআইয়ের ট্রাস্টি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সাংবাদিকদের বলেন, “এই কনসার্টের মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। আজ যখন কনসার্টের মাঝে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হবে, তখন এই হাজার হাজার তরুণ তাতে গলা মেলাবে। আমরা এই তরুণদের সাথেই সংযোগ স্থাপন করতে চাই।”
অন্যদের মধ্যে ভারতের হাই কমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সিআইআইয়ের ট্রাস্টি নাহিম রাজ্জাক কনসার্ট উপভোগ করেন।
এই কনসার্টের মিডিয়া পার্টনার ছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইটে কনসার্টটি সরাসরি দেখানো হয়।
হলোগ্রাফিক উপস্থাপনা
একাত্তর সালের সাতই মার্চ যে ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, ৪৯ বছর পর সেই ভাষণের ত্রিমাত্রিক প্রদর্শনী যেন ফিরিয়ে আনল বাঙালির জাতীয় জীবনের অবিস্মরণীয় সেই বিকেল।
হলোগ্রাফিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে জয় বাংলা কনসার্টে উপস্থিত হাজারো দর্শকের সামনে।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার শুরুর দিকের অংশের আদলে গ্রাফিক ভিডিও উপস্থাপনার মাধ্যমে শুরু হয় হলোগ্রাফি।
এরপর ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনায় দৃশ্যপটে হাজির হন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পারিবারিক পরিসরে আলোচনার প্রেক্ষাপট স্বকণ্ঠে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে।
তাদের কথায় উঠে আসে, কীভাবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব ভাষণে ‘মনের কথা’ বলতে বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করেছিলেন। দুই বোনের বর্ণনার শেষপ্রান্তে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার শেষের কিছু অংশ পাঠ করেন শেখ হাসিনা।
জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠে ভেসে আসে সাতই মার্চের ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ। এ সময় তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান আর্মি স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার হাজার তরুণ। সব শেষে আলোক প্রক্ষেপণে ভেসে উঠে নির্মলেন্দু গুণেরই কবিতার অংশ- ’সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
এ সময় উপস্থিত সবাই ভিআইপি গ্যালারিতে থাকা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার দিকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাও জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন।
সরকারের আইসিটি বিভাগ নির্মিত এই হলোগ্রাফিক উপস্থাপনার পর বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে সিআরআই নির্মিত গ্রাফিক নভেলের উপর একটি তথ্যচিত্রও দেখানো হয়।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী
ছয় বছর ধরে ঐতিহাসিক সাতই মার্চে জয়বাংলা কনসার্ট হলেও এবার মুজিববর্ষে এই আয়োজনে প্রথম এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ভিন্নমাত্রা আনা এই কনসার্টে বঙ্গবন্ধুকন্যা উপস্থিত হন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে।
প্রায় দুই ঘণ্টা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কনসার্ট উপভোগ করে রাত ৯টার দিকে কনসার্ট চলার মধ্যে আর্মি স্টেডিয়াম ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী। ভিআইপি জোনে তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা।
বিকাল থেকে কনসার্টের দর্শক সারিতে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এবং দৌহিত্র ও সিআরআইয়ের ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।