ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের সাত মাসের মাথায় অভিযুক্ত ১৬ আসামির সবার সর্বোচ্চ সাজার রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করে হত্যাসহ নারীর বিরুদ্ধে সব ধরণের সহিংসতার সব ঘটনায় দ্রুত বিচার চেয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
Published : 24 Oct 2019, 04:44 PM
তারা বলছেন, চূড়ান্ত বিচার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের এই সাজা যাতে বহাল থাকে সেবিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে।
পাশাপাশি তিন বছর আগে সোহাগী জাহান তনু ও মাহমুদা আক্তার মিতুসহ অপর হত্যাকাণ্ডগুলোর বিলম্বিত বিচার দ্রুত করতে হবে।
নুসরাত হত্যার সাত মাসের মাথায় মামলার বিচার শেষে বৃহস্পতিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ অভিযুক্ত ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়া মানবাধিকারকর্মী সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রায় নারী নির্যাতনের একটি ঐতিহাসিক রায়; এর জন্য বিচার বিভাগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। এটি বর্তমান সময়কালের শ্রেষ্ঠ বিচার হয়েছে।
“এই বিচারের জন্য হয়তো লাখ লাখ মেয়ের জীবন বেঁচে যাবে। যেসব পুরুষ মনে করেন মেয়েরা ভোগের পাত্র, তাদের সঙ্গে যা খুশি করে ফেলা যাবে, পার পাওয়া যাবে তাদের জন্য একটা সতর্ক বার্তা।”
সারা বিশ্বের নারী নির্যাতনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ রায়কে ‘ল্যান্ডমার্ক’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, সারাবিশ্ব এটার রেফারেন্স নিতে পারবে।
নুসরাতের অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলা, যার ফাঁসির রায় হয়েছে
পরিকল্পিতভাবে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পর অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে গণবিক্ষোভের চাপের কারণেই এতো দ্রুত বিচার হয়েছে এবং জড়িত রাজনৈতিক নেতারাও রক্ষা পাননি বলে মনে করেন নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নুসরাত আর ফিরে আসবে না- এটা সত্য। কিন্তু অন্তত বিচারটা যে হলো এটাই স্বস্তির।
“এরকম আরও অপরাধ আছে সেগুলোরও তদন্ত ও বিচার হওয়া দরকার- তনু হত্যা মিতু হত্যার। প্রতিটিতেই মানুষের জীবনহানি হচ্ছে। প্রতিটি হত্যার দ্রুত বিচার হতে হবে। নাহলে এইভাবে চলতেই থাকবে।”
২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরের একটি ঝোঁপ থেকে কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর (১৯) লাশ উদ্ধার করা হয়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে পরিবারের অভিযোগ।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়। সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত জায়গায় কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। থানা পুলিশ হয়ে সিআইডি এর তদন্ত করে।
একই বছর ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় খুন হন চট্টগ্রামে বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু।
দুই হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র দিতে না পারায় শুরু হয়নি বিচার। এর মধ্যে তনু হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভও হয়েছে। তবুও এঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
নাসিমুন আরা বলেন, উচ্চ আদালতেও নুসরাতের হত্যাকারীদের শাস্তি যেন বহাল থাকে, যেন অপরাধীরা রেহাই না পায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য কঠোরভাবে শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
আসামিরা যেভাবে নুসরাতকে হত্যা করেছে তাতে ১৬ জনই সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য বলেই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির।
নুসরাত হত্যার মামলার রায়ের পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন, নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
খুশী কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও নিম্ন আদালতের রায়টি যেন বহাল থাকে সেজন্য সচেতন থাকতে হবে। রায়ের পর আমাদের হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
“আসামিরা উচ্চ আদালতে আসবে। আমাদের প্রত্যেকটি জায়গা থেকে, প্রতিটি স্তর থেকে সচেতন থাকতে হবে।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, “সব ধরনের হত্যার রায় যেন এভাবে হয়। যেহেতু এখানে আরও আপিলের প্রক্রিয়া বাকি আছে, সেখানেও যেন এভাবে দ্রুত রায় আসে সেটাই আমরা আশা করি।”
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, “এ রায় তো ফ্যান্টাস্টিক! নারী নির্যাতনে দুর্যোগের মুহূর্তে এ রায় দৃষ্টান্তমূলক।”
উচ্চ আদালতেও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার আশা
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা; ঘোষিত রায়ে সন্তোষ জানিয়ে তারা প্রত্যাশা করেছেন, আপিল হলে উচ্চ আদালতেও যেন বহাল থাকে মৃত্যুদণ্ডের রায়।
রায়ের আগে সকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে নুসরাত হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অবস্থান নিয়েছিলেন যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোট।
রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এর আহ্বায়ক শিবলী হাসান বলেন, “এটা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী রায়। সরকার প্রধান যদি আন্তরিক না হতেন তবে এই রায় এত দ্রুত আসতো না।
“আমরা বিচারহীনতার বাইরে গিয়ে এক ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখছি এই রায়ের মাধ্যমে। আমরা চাই এই রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকুক এবং দ্রুত শাস্তি কার্যকর করা হোক।”
তবে ওসি মোয়াজ্জেমসহ প্রশাসনিক ব্যক্তিদের এই রায়ের আওতায় না আনায় ’সন্তুষ্ট’ নন বলে জানালেন তিনি।
শিবলী হাসান বলেন, “বিচারের রায়ের পূর্ণতা পেত যদি তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হত। তবে আদালতের রায়ে এসপি ও ওসিসহ চারজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের কথা বলা হয়েছে।”
নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে সারা দেশে
তবে রায় ঘোষণা হলেও এর কার্যকর হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে চান নুর।
তিনি বলেন, “কারণ এর আগে আমরা এ ধরনের অনেক রায় দেখেছি যেগুলোতে শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা মুক্ত বাতাসে ঘুরেও বেড়ায়।”
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের রায়ের প্রসঙ্গ টেনে নুর বলেন, “প্রথমে এই রায়ে আট জনের ফাঁসির সাজা হয়েছিল, ১৩ জনের যাবজ্জীবন হয়েছিল। কিন্তু পরে আমরা দেখলাম যে সেখান থেকে মাত্র দুই জনের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
“তাই এবারও রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমি মনে করি যে রায় নিয়ে খুব উল্লসিত হবার কিছু নেই।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ডাকসুর ভিপি।
“একইভাবে অন্যান্য যেগুলো হত্যাকাণ্ড যেমন তনু হত্যা, বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার বিচার এরকম দ্রুত হলে আদালতের প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ধরনের মামলায় এত দ্রুত বিচারের রায় আমরা এই প্রথম দেখলাম। এজন্য আমরা সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
“অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিটা দেওয়া হয়েছে এটার জন্য আমরা যারা নারী বিষয় নিয়ে কাজ করি বা তাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করি তাদের একটা জয় হয়েছে।”
স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় যেসব শিক্ষক ধর্ষণ ও সহিংসতায় জড়িত হন, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা যাবে, রায় এই বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করেন ঢাবির এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলার পরেই শুধু কাজ করা হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে বা প্রতিষ্ঠানে কেন কাজ করা হচ্ছে না, সেটা আমাদের দেখতে হবে।”
ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নুসরাত হত্যার বিচার আমরা ৬২ দিনের মধ্যে পেয়েছি। এটার জন্য আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব খুশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদও এই রায়কে সাধুবাদ জানায়। আমরা চাই নুসরাত হত্যার বিচারের মত প্রত্যেকটা হত্যা-ধর্ষণের বিচারের রায়ও খুব দ্রুততার সহিত হয়ে যায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মো. ফয়েজউল্লাহ বলেন, “নিম্ন আদালতে যে রায় হয়েছে সেটাতে আমরা সন্তুষ্ট আছি। কিন্তু এই রায় যাতে উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে সেই দাবি থাকবে।
‘‘আমরা চাই প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এর বাইরেও নারী নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটছে তার সুষ্ঠু বিচার হোক এবং এই রায়ের মধ্য দিয়ে অন্যান্য বিচারের রায়ও যাতে দ্রুত হয়ে যায় সেই প্রত্যাশা থাকবে।”