নুসরাত হত্যায় ১৬ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড

অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। 

নাজমুল হক শামীম ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2019, 05:26 AM
Updated : 25 Oct 2019, 04:01 AM

পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া ওই হত্যাকাণ্ডের সাত মাসের মাথায় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ বৃহস্পতিবার জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন।

দণ্ডিত এই ১৬ আসামির মধ্যে রয়েছেন নুসরাতের শিক্ষক- সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, যিনি এই হত্যাকাণ্ডের হুমুকদাতা।

রয়েছেন মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন এবং সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম, যারা হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।

নুসরাতের তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন, যারা একইসঙ্গে আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন; নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর যারা ফের স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পরীক্ষার হলে বসেছিলেন, সেই সঙ্গে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং অধ্যক্ষ সিরাজের কয়েকজন সহযোগী, যারা এই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাদের সবার সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে আদালতে। 

নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে সারা দেশে

বিচারক তার রায়ে বলেছেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা ফেনী জেলার অন্যতম বড় বিদ্যাপীঠ। দুই হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী সেখানে পড়ছে। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার আলোকজ্জ্বল ভূমিকায় ‘কালিমা লিপ্তকারী’ এ ঘটনা ‘বিশ্ব বিবেককে’ নাড়া দিয়েছে।

“নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজদ্বীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে ইতোমধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয়। বিধায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য।”

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ (১)/৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।

মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ডাদেশ কার্যকর করতে এবং জরিমানার অর্থ আদায় করে নুসরাতের বাবা-মাকে দিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

 

নুসরাতের পরিবারের সদস্যরার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত আসামিদের সাজা কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

বাদীপক্ষের কৌঁসুলি এম শাহজাহান সাজু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই রায়কে বলেছেন ‘দৃষ্টান্তমূলক’। ৬২ কার্যদিবস শুনানির পর এই রায় দেওয়া হয়েছে, যাকে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’ বলেছেন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট নন, রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। নিয়ম অনুযায়ী, এই রায়ের বিরুদ্ধে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন তারা।

এ মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম সেটাই হয়েছে। আমরা পেশাদারিত্বের সাথে মেধা দিয়ে কাজ করেছি। প্রত্যেকের পরিবারে নুসরাত আছে, আমরা সে ভাবনা নিয়েই কাজ করেছি।”

 

দণ্ডিত ১৬ আসামি

অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ্দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আলম, সাইফুর রহমান, মো. জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, মো. আফসার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মো. শামীম, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমিন ও মহিউদ্দিন শাকিল

সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা মামলা করার পর গত ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে অধ্যক্ষ সিরাজকে।

সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পক্ষে নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ।

এর মধ্যেই ৬ এপ্রিল পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষা কেন্দ্র সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে ঢাকায় এনে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল; টানা পাঁচ দিন যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দুদিন পর তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত নেয়।

নুসরাতকে যখন ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছিল, তখনও তিনি বলছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করে যাবেন। প্রতিবাদী এই তরুণীর জন্য প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয় গোটা দেশজুড়ে।

৭ এপ্রিল নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন, যাতে তিনি অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যান।

ঘড়ির কাঁটার দিকে: অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, আবছার উদ্দিন, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, রুহুল আমীন, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, কামরুন নাহার মনি, মাকসুদ আলম, হাফেজ আব্দুল কাদের, . ইমরান হোসেন, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামীম ও শাহাদাত হোসেন শামীম

 

ঘটনাক্রম

২৭ মার্চ: নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধ, অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার

৬ এপ্রিল: পরীক্ষার হল থেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন

৮ এপ্রিল: ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে নুসরাত, মামলা দায়ের

১০ এপ্রিল:  নুসরাতের মৃত্যু, মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর

২৯ মে: ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল

৩০ মে: হাকিম আদালত থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর

১০ জুন: অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল, গ্রেপ্তার পাঁচজনকে অব্যাহতি

২০ জুন: ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

২৭ জুন: বাদীর সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্যে দিয়ে শুনানি শুরু

৯ সেপ্টেম্বর: সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ

৩০ সেপ্টেম্বর: রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ

২৪ অক্টোবর: রায়ে ১৬ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড

 

নুসরাত হত্যার মামলটি তদন্ত প্রথমে করছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন; কিন্তু ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপর।

পিবিআইর পরিদর্শক শাহ আলম এজহারভুক্ত আট আসামির সঙ্গে আরও আটজনকে যুক্ত করে ১৬ জনকে আসামি করে গত ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

তার পরের মাসে ২০ জুন ১৬ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬ আসামির বিচার। ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।

অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে আলাদা মামলা হয়েছে।