নুসরাতের খাতার পাতায় অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের বর্ণনা

শিক্ষক সিরাজ উদ-দৌলার কাছে কীভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হতেন, তা নিজের খাতার পাতায় লিখে গেছেন মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি।

নাজমুল হক শামীম ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2019, 04:28 PM
Updated : 10 April 2019, 04:52 PM

ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা করার পর আগুনে জ্বলতে হয়েছে প্রতিবাদী এই তরুণীকে; পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বুধবার রাতে নুসরাত মারা যাওয়ার আগেই ফেনীতে তার বাড়িতে ওই খাতাটি পায় পুলিশ।

নুসরাত তার খাতার দুই পৃষ্ঠায় সহপাঠীদের উদ্দেশে অনেক কিছু লিখেছেন। অধ্যক্ষের মুক্তির পক্ষে তার যেসব সহপাঠি দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের সমালোচনাও ছিল লেখায়।

সহপাঠীদের উদ্দেশে নুসরাত লিখেছেন, “তোরা সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে সব জানার পরও কিভাবে তার মুক্তি চাইতেছিস, তোরা জানিস না ঐদিন ক্লাসে কি হইছে, উনি আমার কোন জায়গায় হাত দিয়েছে এবং আর কোন জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে।

“উনি আমাকে বলছে, নুসরাত ঢং করিও না। তুই প্রেম করিস না, ছেলেদের সাথে প্রেম করতে ভাল লাগে? ওরা তোরে কি দিতে পারবে, আমি তোকে পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেব।”

নুসরাতের হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার মধ্যে একটি অংশ এটি। দুই পৃষ্ঠাজুড়ে গত ২৬ মার্চ ঘটে যাওয়া ঘটনার বেশ কিছু অংশ লিখে গেছেন তিনি।

অগ্নিদগ্ধ নুসরাত জাহান রাফিকে শনিবার আনা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে; তখনও তিনি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

২৬ মার্চের ঘটনার পর শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল নুসরাতের পরিবার।

ওই মামলায় মাদ্রাসা শিক্ষক সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ।

এরই মধ্যে গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে তাকে কয়েকজন ছাদে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে নুসরাত নিজেই বলে গেছেন।

এই ঘটনার পর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী থানায় আরেকটি মামলা করেছেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। আগের মামলায় গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ সিরাজসহ মোট আটজনের নাম উল্লেখসহ বোরকা পরা অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। অধ্যক্ষ সিরাজকে বুধবার রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ।

দেহের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাতকে ঘটনার দিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে আনা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও নুসরাত বলছিলেন মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের অনুসারীদের চাপ দেওয়ার কথা। এই তরুণী দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করে যাবেন, কোনো ছাড় দেবেন না।

 

নুসরাত হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নুসরাতের খাতাটি মঙ্গলবার বিকালে তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছেন তারা।

তিনি বলেন, নুসরাতের ঘরে পড়ার টেবিলের বই-খাতা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটি খাতার পৃষ্ঠা উল্টালে ওই লেখা দেখতে পান তিনি। কয়েক পাতা পর আরও একটি লেখা পান।

ঢাকা মেডিকেলে নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বাবা

তাৎক্ষণিকভাবে পাতাসহ খাতাটি জব্দ করে বলে তদন্ত কর্মকর্তা কামাল জানান।

তিনি বলেন, “নুসরাতের ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় এটি একটি ডকুমেন্ট হিসেবে কাজে লাগবে। পুলিশ এই লিখাগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে যা যা করণীয় তা করবে। যাদের নাম আছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে।”

খাতার লেখায় দিন-তারিখ উল্লেখ না থাকলেও বিষয়বস্তু বিবেচনায় এটি কয়েকদিন আগের বলে মনে করছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

হাসপাতালে নুসরাতের নিজের দেওয়া বক্তব্যের পর এই খাতার লেখা অপরাধ প্রমাণে স্পষ্টই গুরুত্ব পাবে।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ ও মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার শাস্তির দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদী নুসরাতের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি সারা বাংলাদেশেই এখন আলোচিত ঘটনা।

অপরাধীদের শাস্তির বার্তা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও এসেছে। নুসরাতকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার নির্দেশও ছিল প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু তাকে স্থানান্তরের মতো পরিস্থিতি ছিল না বলে চিকিৎসকরা জানানোর পর দেশেই চলছিল চিকিৎসা।